পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওঠা প্রথম সূর্যের দেখা নয়। রাস্তার বাঁকে ফেলে আসা স্বর্গীয় নিসর্গ নয়। বরং এ সব কিছুর মাঝে বসে খরস্রোতা নদীতে মাছের অপেক্ষায় বঁড়শি ফেলাতেই এখন বেড়ানোর আনন্দ চেটেপুটে খাচ্ছেন অনেকে। মাছ ধরা-পাগল মানুষদের সেই প্যাশনকে সঙ্গী করেই দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে মেছো-পর্যটন। পোশাকি নাম ‘স্পোর্টস ফিশিং’। কলকাতার সংস্থা রোগ অ্যাঙ্গলার্স-এর দাবি, দেশের বাকি অংশের মতো এ রাজ্যেও সম্ভাবনা বাড়ছে রোমাঞ্চের পর্যটন (অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম) ব্যবসার এই নয়া শাখার।
অধিকাংশ বাঙালির কাছেই মাছ ধরা মানে পুকুর পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। হাতে বঁড়শি, চোখ ফাতনায়। উৎসব-অনুষ্ঠানে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। জাল ফেলতেও দেখা যায় খাল-বিল-নদী-পুকুরে। কিন্তু মেছো-পর্যটন এই দুই আঙ্গিকেই আলাদা। প্রথমত এখানে ধরা মাছ খাওয়ার প্রশ্ন নেই। বরং তাকে জ্যান্ত ফেরাতে হয় নদীর জলে। দ্বিতীয়ত, পুকুরে ছিপ ফেলার সঙ্গে এটি ততটাই এক, যতটা সমুদ্রে পা ভেজানোর সঙ্গে মেলে ‘স্কুবা ডাইভিং’। এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মহল মনে করে, ভারতের যা প্রাকৃতিক বৈচিত্র, তাতে এই মেছো পর্যটনের সম্ভাবনা প্রচুর। বিশেষত যেখানে বরাবরই মাছ ধরার নেশা আছে এ দেশের মানুষের মধ্যে।
ভারতে এই পর্যটনের জনপ্রিয়তা তুলনায় নতুন হলেও, উন্নত দুনিয়ায় এর ব্যাপ্তি বিশাল। পর্যটন শিল্পের দাবি, ইউরোপে বিনোদনের জন্য মাছ ধরেন প্রায় আড়াই কোটি জন। খরচ করেন ২ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা। ইউরোপিয়ান অ্যাঙ্গলার্স অ্যালায়েন্স ও ইউরোপিয়ান ফিশিং ট্যাকল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশেনের হিসেব অনুযায়ী, মাছ ধরার যন্ত্র বা উপকরণই তৈরি করে ২,৯০০ সংস্থা। সেখানে কাজ করেন প্রায় ৬০ হাজার জন। আমেরিকাতেও স্পোর্টস ফিশিংয়ে যুক্ত ৪.৪ কোটি মানুষ। তাঁরাও বছরে খরচ করেন ২ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সেই সূত্রে কাজের সুযোগ হয় ১০ লক্ষ লোকের। আগামী দিনে ভারতেও এই শিল্পের বড়সড় বাজার হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স রিপোর্ট বলছে, আগামী দিনে পর্যটন ব্যবসার ৫০% আসবে এ ধরনের বেড়ানো থেকে। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ারও দাবি, দেশে এই ব্যবসা বাড়ছে ২০-২৫%।
পর্যটন এখন অনেক সময়ই শুধু যাই-খাই-বেড়াইয়ের মধ্যে আটকে থাকছে না। আমদানি হচ্ছে রোমাঞ্চ। সেই তালিকাতেই জায়গা করে নিচ্ছে বঁড়শি-চার। খেলিয়ে মাছ ধরার নেশা, ট্রাউট বা মাহশিরের মতো মাছ ধরার ওস্তাদি আর সুন্দর জায়গায় নদীতে ছিপ ফেলার উত্তেজনা টেনে আনছে পর্যটককে। সাধারণত এ ধরনের ভ্রমণের পুরোটাই প্যাকেজ হিসেবে বিক্রি হয়। রেল বা বিমানের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং হয়ে জলের বোতল— সব দায়িত্বই ভ্রমণ সংস্থার। অন্য বেড়ানোর থেকে ফারাক হল, হয়তো দেখা যাবে, কোনও পাহাড়ি অঞ্চলে পাঁচ দিন ঘোরার তিন দিনই বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাছ ধরার জন্য। রোগ অ্যাঙ্গলার্সের কর্তা চন্দন গুপ্তর মতে, এই পর্যটনে মজবেন তাঁরা, যাঁদের মাছ ধরার নেশা আছে।
এই বেড়ানোয় পর্যটকের বাড়তি পাওনা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। প্রয়োজনে সরঞ্জামও। কোন নদীর কোন বাঁকে কী মাছের দেখা মিলবে, তা সকলের জানা নয়। সে বিষয়ে তাঁরা অল্প-বিস্তর সাহায্য পেতে পারেন।
শখে ধরার মতো মাছের কমতি এ দেশে নেই। গোল্ডেন মাহশির, গুঁচ, ট্রাউট থেকে শুরু করে চকোলেট মাহশির। বিভিন্ন নদীতে এদের দেখা মেলে। একটি সূত্রে দাবি, সংরক্ষিত জঙ্গলে মাছ ধরা বন্ধের আগে ভারতে এই ব্যবসা ছিল ৩০ কোটির। ফলে এ দেশে মেছো-পর্যটনের সম্ভাবনা যে যথেষ্ট, তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এ দেশে এই নেশার সূত্রপাত ব্রিটিশদের হাত ধরে। ১৮৭৩ সালে মাহশির ধরার প্রচলন করেন তাঁরা। তাঁদের হাত ধরেই জনপ্রিয় হয় স্পোর্টস ফিশিং। আগে ভারতে মেছো-পর্যটনে যাঁরা যোগ দিতেন, তাঁদের অধিকাংশই বিদেশি। এখন ভিড় বাড়ছে ভারতীয়দের।
যাঁরা এমন শখের মাছ ধরেন, তাঁদের বলে ‘অ্যাঙ্গলার’। এঁদের শখ মেটাতে সিকিম, অরুণাচল, অসম, উত্তরাখণ্ডে পর্যটন ব্যবসা শুরু করেছেন চন্দনবাবুরা। দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে পর্যটন বৃত্ত তৈরির জন্য গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অথরিটির (জিটিএ) সঙ্গে কথা বলছেন। জিটিএ-র ইডি (পর্যটন) সোনম ভুটিয়া জানান, মিরিকেও পরিকল্পনা রয়েছে।
সুতরাং, মেছো পর্যটনের জালে আটকে বদলে যাচ্ছে আপ্তবাক্য। নতুন স্লোগান— ‘মৎস্য ধরিব ঘুরিব সুখে’।