শঙ্কা ছিলই। এ বার তা হিসেবের খাতায় ফুটে উঠছে স্পষ্ট। বরাতের অভাবে ধুঁকছে বানতলা চর্মনগরী। নতুন বছরের গোড়ায় প্রত্যাশিত ৫০০ কোটি টাকার বরাতের এক আনাও পায়নি রাজ্যের চর্মশিল্প। আর তাদের এই লাগাতার বেহাল দশার কারণে গত তিন মাসে রাজ্যও রাজস্ব খাতে হারিয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ জন্য শিল্পমহলের অভিযোগের তির নোট বাতিল ঘিরে তৈরি হওয়া নগদ-সঙ্কটের দিকেই।
নোট বাতিলের জেরে চুক্তি অনুযায়ী সময়ে সরবরাহ না-করার কারণে ইউরোপ, আমেরিকার ক্রেতারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা চর্মপণ্যের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার বরাত বাতিল করে দিয়েছে নভেম্বরে। ডিসেম্বরেও প্রায় একই দশা। ফলে বিশ্ব বাজারে মুখ পুড়েছে রাজ্যের চর্মশিল্পের।
বস্তুত, নোটের আকালে বানতলা চর্মনগরীর সংস্থাগুলি বরাতের জিনিস সঠিক সময়ে ও দামে সরবরাহ করতে না-পারায় প্রমাদ গুনেছিল চর্মশিল্পমহল। আশঙ্কা ছিল, এই বরাত একবার বাতিল হয়ে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী ফল ভোগ করতে হবে তাদের। চুক্তির খেলাপ ঘটলে ভবিষ্যতেও বিদেশি ক্রেতাদের তালিকায় ঠাঁই পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। সেই আশঙ্কাই এ বার সত্যি হচ্ছে বলে দাবি শিল্পের। বানতলার চর্ম ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড়দিন ও নতুন বছরের বাজারে মোটা অঙ্কের ব্যবসার সঙ্গে এ বার মার খাচ্ছে রফতানির বাজারে তাঁদের ভাবমূর্তিও।
তলানিতে ঠেকা ব্যবসার ছাপ বানতলার আনাচে কানাচে। ৩৫১টি কারখানার মধ্যে ১০৫টি বন্ধ। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ৮০টি বন্ধ হয়েছে বলে দাবি চর্মনগরীর ব্যবসায়ীদের। চলতি জানুয়ারি মাসে ঝাঁপ পড়েছে আরও ২৫টির। এর মধ্যে ৮৫% ট্যানারি। ক্যালকাটা লেদার কমপ্লেক্স ট্যানারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমেদ খান বলেন, ‘‘আস্থা নেই বলে রফতানির বরাত আসছে না। নোটের আকালে মার খেয়েছে দেশের মধ্যে চাহিদাও।’’ বানতলার মোট উৎপাদনের ৭৫% রফতানি হয়। দেশে বিক্রি হয় বাকি ২৫%।
বানতলার কালো মেঘের ছায়া পড়ছে রাজাবাজারের চামড়ার গুদামেও। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, কাঁচা চামড়া রাখার ৪০০টি গুদাম রয়েছে। তার মধ্যে ২৫০টি পুরোপুরি বন্ধ। বাকিরাও একই পথে হাঁটছে। কারণ নোটের আকালে কাঁচামাল অর্থাৎ চামড়ার জোগানে টান পড়েছে। নগদহীন বাজারে কাঁচা চামড়ার মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছে বলে চর্মশিল্পমহলের অভিযোগ।
নোট সঙ্কটে উৎপাদন খরচ এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বলেও দাবি চর্মশিল্পের। কাঁচা মালের দাম বেড়েছে ৩০%। এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিক সমস্যা। নোটের টানাটানিতে মজুরি দেরিতে পাচ্ছেন তাঁরা। ১০০ টাকার নোট কম পাওয়ায় দিন গুজরানেও সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা। অধিকাংশ শ্রমিক ট্যানারি ছেড়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। আর যাঁরা আছেন, তাঁরা সাধারণ মজুরির দ্বিগুণ দর হাঁকছেন। সব মিলিয়ে পুরনো দামে তৈরি করা যাচ্ছে না চামড়ার জিনিস।
লেদার এক্সপোর্ট কাউন্সিলের দাবি, দেশ জুড়েই চর্মশিল্পের বেহাল অবস্থা। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাজার দখল করতে ঝাঁপাচ্ছে চিন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। গত আর্থিক বছরে বানতলায় প্রায় ৬৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। এ বছর তা এখনও আটকে রয়েছে ৫,৩০০ কোটি টাকায়। এই ঘাটতি পূরণ হবে বলে মনে করছে না কাউন্সিল। কারণ, আর্থিক বছর শেষ হতে আর মাত্র আড়াই মাস বাকি।