আর্থিক বৃদ্ধিকেই স্তিমিত করে দিচ্ছে না তো বৈষম্য? প্রতীকী ছবি।
বাজেট এসে গেছে। সংবাদমাধ্যমে রোজ শুনতে আর দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞদের গুরুগম্ভীর আলোচনা। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়াতে সবাই ঘোরতর চিন্তিত। অর্থমন্ত্রী বাজেটে এ নিয়ে কী নয়া নীতি প্রণয়ন করলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়ানো যাবে তা নিয়ে সবাই মতামত দিচ্ছেন। দেশের ভাল সবাই চান কি না। শিল্পমহল একটু চিন্তিত। বর্তমান সরকার শিল্পবান্ধব কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু নিঃসন্দেহে শিল্পপতি-বান্ধব এই সরকারের এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। পরের বছর সাধারণ নির্বাচন। ভোটরক্ষার স্বার্থে অর্থমন্ত্রী যদি আমজনতার দিকে একটু ঝুঁকে পড়েন তা হলেই চিত্তির। দেশের ভাল আবার এক বছর পিছিয়ে যাবে! কাজেই কোম্পানি কর কতটা কমালে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পক্ষে ভাল, ব্যবসা-বাণিজ্যে কী কী সুযোগসুবিধা আর পরিষেবার ব্যবস্থা করলে দেশে উৎপাদন বাড়বে, এয়ার-ইন্ডিয়াকে যতটা কম দামে সম্ভব অবিলম্বে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া কেন দেশের ভালর জন্য জরুরি, খাদ্যে ভর্তুকি আর কতটা কমানো যেতে পারে এ সব নিয়ে সুচিন্তিত মতামত ও আলোচনার শেষ নেই। মহার্ঘ-ভাতা বঞ্চিত এই রাজ্যে আমাদের মতো চাকুরিজীবীদের আলোচনা অবশ্য আয়করের হার অর্থমন্ত্রী কমান কি না মূলত তাই নিয়ে। অন্য বিষয়গুলোতে আমাদের মাথাব্যথা কম। জিএসটি চালু হওয়ার পরে মদ-সিগারেট ছাড়া অন্য জিনিসপত্রের দামের ওপর বাজেটের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। সে দিক দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত।
দেশের ভাল নিয়ে এত সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে বসে একটা ছোট্ট খবর বোধহয় বিশেষজ্ঞদের চোখ এড়িয়ে গেছে। বা এ-ও হতে পারে যে তাঁরা এ বিষয়টাকে আলোচনার যোগ্য মনে করেননি। গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিষদের বার্ষিক সাধারণ সভা শুরু হবার ঠিক আগে অক্সফ্যাম নামে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সারা বিশ্বের আর্থিক বৈষম্য নিয়ে একটি নথি প্রকাশ করে। এই নথিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের আর্থিক বৈষম্য নিয়েও কিছু পর্যবেক্ষণ আছে যেগুলো বেশ চমকে ওঠার মতো। যদিও আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের— বিশেষ করে যাঁরা সংবাদ মাধ্যমে নিরন্তর বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের এ সব নিয়ে খুব একটা হেলদোল আছে বলে মনে হয় না।
যেমন ধরুন, অক্সফ্যাম সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে গত এক বছরে ভারতে যত মূল্যের সম্পদ তৈরি হয়েছে তার ৭৩ শতাংশ গেছে সবচেয়ে সম্পদশালী এক শতাংশ মানুষের কাছে। এক বছর আগে এই এক শতাংশের কাছেই কিন্তু ছিল ভারতের মোট সম্পদ মূল্যের ৫৩ শতাংশ। অন্য দিকে, দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে গেছে এই নতুন ভাবে তৈরি হওয়া সম্পদের এক শতাংশ। বা ধরুন এই তথ্যটা। ভারতে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন এ রকম এক জন শ্রমিক তাঁর পঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে যা আয় করেন, একটি বড় ভারতীয় বস্ত্র কোম্পানির প্রধান পরিচালক গড়ে তার থেকে বেশি আয় করেন আঠারো দিনে! মনে রাখবেন, একটা বড় অংশের ভারতীয় শ্রমিক যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন তাঁরা সরকারি ভাবে যেটা ন্যুনতম মজুরি সেটাও পান না।
বিশেষজ্ঞরা সম্ভবত বলবেন যে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এগুলো খারাপ লাগার মতোই। কিন্তু দেশের ভালর জন্য, মানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে গেলে এটা অবশ্যম্ভাবী। আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের বিচারে ওপরের দিকে ওঠার প্রচেষ্টা কমে যেতে পারে। মানে, আপনি যদি জানেন যে আপনি বহু পরিশ্রম ও খরচ করে কোনও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করলে আপনার যে অতিরিক্ত আয় সেটা সরকার কর বসিয়ে নিয়ে নেবে আর তা দিয়ে ভর্তুকি দেবে যারা দরিদ্র তাঁদের তা হলে আপনার সেই দক্ষতা অর্জন করার প্রচেষ্টাটাই কমে যেতে পরে। তাতে দেশের সমূহ ক্ষতি। কারণ, আপনি বা আপনার মতো অন্যরা যদি দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা না বাড়ান তা হলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির কী হবে?
নীতিবাগীশ কেউ বলতে পারেন যে আর্থিক বৃদ্ধিটাই তো দেশের উন্নতির একমাত্র মাপকাঠি নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ যে দেশে বাস করেন, যে দেশে পাঁচের চেয়ে কম বয়সী প্রতি ১০০ শিশুর ৩৮ জন এমন অপুষ্টির শিকার যা বড় হওয়ার পর শুধু তার শারীরিক নয়, মানসিক বিকাশকেও স্তিমিত করে, প্রতি তিন জন মানুষের এক জন যেখানে পেটে খিদে নিয়ে রাত্রে ঘুমোতে যান, সেখানে আগে এ সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি। তাতে যদি আর্থিক বৃদ্ধি একটু কমে যায় তবে তাই হোক। অন্য দিকে বিশেষজ্ঞরা বলবেন যে এ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্যেই আর্থিক বৃদ্ধি জরুরি। দেশের উৎপাদন বাড়লে যে অতিরিক্ত আয় তৈরি হবে তার খানিকটা অন্তত চুঁইয়ে নীচের দিকে নামবে। নীচের তলার মানুষের এই বাড়তি আয় ধীরে ধীরে ওপরের সমস্যাগুলো কমাবে। আর্থিক বৃদ্ধি না হলে এটাও হবে না।
হক কথা। একটা আশঙ্কা কিন্তু থেকে যায়। এই ঘোরতর আর্থিক বৈষম্য আর্থিক বৃদ্ধিটাকেই স্তিমিত করছে না তো? যে কোনও ব্যাপারে দক্ষতা অর্জনের জন্য মেধা জরুরি। কিন্তু বোধহয় একই রকম জরুরি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ-সুবিধা আর পরিকাঠামো। আমি-আপনি আয়ের ও সম্পদের বিচারে সমাজের ওপরতলার ১০ ভাগে আছি। আমাদের সন্তান-সন্ততিকে আমরা তাদের বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি, যে ভাবে তাদেরকে প্রস্তুত করতে পারছি ভবিষ্যতের শ্রমের বাজারে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠার জন্য, সেটা কি কোনও ভাবে সম্ভব আর্থিক ভাবে অনেক পিছিয়ে থাকা কোনও পরিবারের পক্ষে? আমরা যদি এটা মেনে নিই যে একটি শিশুর মেধা কোন পরিবারে সে জন্মাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে না, তা হলে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ শিশুর মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ আমরা তাদের দিতে পারছি না। ফলে দেশ হারাচ্ছে তার সম্ভাব্য দক্ষ শ্রমিকদের অন্তত অর্ধেককে। যে হতে পারতো ভাল প্রযুক্তিবিদ, সে হয়তো চালাচ্ছে রিকশা, আর যার মেধায় রিকশা চালানো হতে পারত উপযুক্ত পেশা, পারিবারিক সম্পদের কল্যাণে বেসরকারি কলেজ থেকে পাশ করে সে করছে ডাক্তারি। ক্ষতি হচ্ছে দেশের, কমছে আর্থিক বৃদ্ধি।
এখানেই সরকারের ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন ওঠে। সরকার যদি আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে সত্যিই চিন্তিত হত, তা হলে আমাদের মেধাসম্পদের উপযুক্ত বিকাশের জন্য একটা সক্রিয় প্রচেষ্টা দেখা যেত। ওপরের তলার অল্প কিছু মানুষের জন্য নয়, সবার জন্য। দরকার মেধার বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও পরিকাঠামোর যে বৈষম্য আমাদের দেশে রয়েছে সেটা কমিয়ে আনা। এটা করা সম্ভব শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-সহ সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে টাকাটা কোথা থেকে আসবে? একটা সম্ভাব্য উৎস হতে পারে উত্তরাধিকার কর।
ধরুন, সরকার আগামী বাজেটে প্রস্তাব করল যে ১০০ কোটি টাকার ওপর যাঁদের সম্পদ তাঁদের সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় ৩০ শতাংশ সরকার নিয়ে নেবে উত্তরাধিকার কর হিসেবে। নিশ্চিন্তে বলা চলে যে এই প্রস্তাব ভারতের ৯৯ শতাংশ মানুষকে প্রভাবিত করবে না। কারণ তাঁরা ১০০ কোটির সম্পত্তি রেখে পরলোক গমন করেন না। উত্তরাধিকারীরা পারিবারিক সম্পদ নিজেরা অর্জন করেন না। কাজেই এই কর সম্পর্কে তাঁদেরও অভিযোগ করার কিছু নেই। তাঁরা এই সম্পদের অধিকারী হন কারণ তাঁদের সৌভাগ্য যে তাঁরা কোনও ধনী পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। এই সৌভাগ্যের ফলে তাঁরা এমন সুযোগ-সুবিধা পান যা থেকে সমাজের ৯৯ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত। কাজেই তাঁরা যদি ওই করবাবদ নিয়ে নেওয়া ৩০ শতাংশ আবার ফেরত চান তাঁদেরকে তা অর্জন করতে হবে নিজস্ব মেধা ও দক্ষতা দিয়ে।
এই কর বসিয়ে কত টাকা সরকার আয় করতে পারবে? একটা ছোট্ট হিসেব দিলে খানিকটা হয়তো আন্দাজ করা যাবে। ভারতে এখন ডলার বিলিওনেয়ার ১০১ জন। মানে এদের প্রত্যেকের সম্পত্তির মূল্য প্রায় ৬৫০০ কোটি টাকা। এই ১০১ জনের মধ্যে ৫১ জনের বয়স ৬৫-র বেশি। এই ৫১ জনের সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। ধরে নেওয়া যায় আগামী ২০ বছরে এই ৫১ জনের সম্পদ তাঁদের উত্তরাধিকারীদের কাছে যাবে, তা হলে শুধু এদের ওপর বসানো উত্তরাধিকার কর থেকে সরকার আগামী বিশ বছরে তিন লক্ষ কোটি টাকার বেশি আয় করতে পারবেন। যে টাকাটা ব্যবহার করা যাবে সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের মেধার বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে।
সরকার কি সে পথে হাঁটবেন? বাজেট নিয়ে কথাবার্তায় এই বিষয়টাও একটু আলোচিত হওয়া বোধহয় প্রয়োজন। হাজার হোক দশের ভাল তো দেশেরই ভাল।