মহালয়া চলে গিয়েছে। গায়ে লাগতে শুরু করেছে পুজোর হাওয়া। সঙ্গে শরতের মিঠেকড়া রোদ। বাসে-মেট্রোয় উঠলেই ভিড়ের চাপ। বোঝাই যাচ্ছে এ ভিড় সেই শহুরে ব্যস্ততার ভিড় নয়। নয় পেশার চাপও। রাজ্যবাসী ডুব দিয়েছে পুজোর মেজাজে। চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। পরিবার, আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠদের জন্য। এই অলস-ব্যস্ততার শরিক আপনি বা আমি সকলেই।
এখানেই তো শেষ নয়। এর পরে রয়েছে পুজোর ক’টা দিন। বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া। তার পর আসবে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা। ফের উপহার দেওয়া-নেওয়া। তবেই না এ দফায় শেষ হবে খরচের ধাক্কা!
এই ব্যয়-চক্র অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রত্যেক বছর এরই মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাদের। কিন্তু একটি বারের জন্য আমরা তলিয়ে ভাবি কি, এই এক মাসে আমাদের মানিব্যাগের উপর কোন পর্যায়ের ধাক্কা যায়?
পুজোর খরচ বন্ধ করার পরামর্শ কখনওই দিচ্ছি না। কারণ, সারা বছর হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পরে এই ধরনের উৎসব কিংবা আচার-অনুষ্ঠানগুলোই মাথায় বাড়তি অক্সিজেন জোগায়। কিন্তু খরচের বাধ্যবাধকতায় সেই মাথাকেই ভারাক্রান্ত করা কি ঠিক? বরং এই খরচকে সাধ্যের খাতায় নিয়ে আসার কথাও তো এক বার ভাবতে পারি আমরা, যাতে পরবর্তী কালে বড় কোনও প্রয়োজনের সঙ্গে আপস করতে না হয়! কী ভাবে? তা নিয়েই খানিক আলোচনা করব এ বার।
খরচের রিহার্সাল
পুজো তো হঠাৎ হাজির হয় না। অনেক আগে থেকেই জানা থাকে দিনক্ষণ। অতএব প্রত্যেক বছর পুজোর পরেই মোটামুটি ১০% খরচ বৃদ্ধি ধরে আমরা পরবর্তী পুজোর খরচের একটা প্রাথমিক হিসেব কষে ফেলতে পারি। তাতে সুবিধা দুটো। প্রথমত, এক বছর আগে থেকেই ধীরে ধীরে সঞ্চয় করা যায়। দ্বিতীয়ত, খরচের ধাক্কা গায়ে লাগে না।
পুজোর খরচের একটা কাল্পনিক হিসেব তৈরি করা যাক। একেক জনের হিসেব অবশ্যই একেক রকম হবে।
কী ভাবে এই খরচ তোলা যাবে? পদ্ধতি অনেক। ব্যাঙ্কে রেকারিং অ্যাকাউন্ট চালু করতে পারেন। অথবা লিকুইড ফান্ডে ১২ মাসের জন্য জমাতে পারেন ৪,৫০০ টাকা করে। এমন সময়ে অ্যাকাউন্ট চালু করতে হবে যেন পুজোর মরসুমের ঠিক আগে সেটা ম্যাচিওর করে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি একটি স্বল্প মেয়াদি সঞ্চয়। এ ক্ষেত্রে ইকুইটি বা হাইব্রিড ফান্ডে টাকা রাখা ঠিক হবে না।
যদি পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তা হলে তার জন্যও বাজেট তৈরি করুন। সঞ্চয় করুন সেই হিসেব ধরেই।
ধাপে ধাপে ব্যয়
একটু আগে যা বলছিলাম। পুজোর কিছু দিন আগে থেকেই আমাদের কেনাকাটার ধুম পড়ে। সেটা না করে দফায় দফায় উপহার কেনা যেতেই পারে। সে ক্ষেত্রে লিকুইড ফান্ড থেকে টাকা তুলে বাজার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংস্থাগুলি বছরের বিভিন্ন সময়ে ছাড় দেয়। সেই সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। আজকাল অনলাইনে কেনাকাটাতেও বড় অঙ্কের ছাড় মেলে। সেখান থেকে কিনলে ভিড়ভাট্টাও এড়ানো যায়। জিনিস পছন্দ না হলে বদলানোর সুযোগ তো আছে সেখানেও।
লগ্নিতে হাত নয়
এই ভুলটা অনেকেই করেন। পুজোর কেনাকাটার জন্য চালু এসআইপি থেকে মাঝ পথে টাকা তোলেন তাঁরা। অনেকে আবার একই কারণে এসআইপির একটি-দু’টি কিস্তি দেনও না। হয়তো সেই সঞ্চয় তাঁরা করছিলেন অবসর জীবনের পরিকল্পনা বা সন্তানের পড়াশোনার খরচের জন্য। এতে আর্থিক পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়। ইকুইটি ফান্ডে মাত্র একটি কিস্তিও বাউন্স করলে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি—
খরচে সমঝোতা
পুজোয় উপহার বিনিময় তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু এতে খরচ আরও বাড়ে। সমস্যা হয় দু’পক্ষেরই। আলোচনার মাধ্যমে কি এই অভ্যাস বন্ধ করা যায়? গেলে ভাল। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, তা হলে গিফ্ট কার্ড দিয়ে কর্তব্য সারতে চেষ্টা করুন।
সমাজে থাকতে গেলে সামাজিকতা বজায় রাখতেই হবে। বলছি না যে, সেই সমস্ত চুকিয়ে দিন। তা সম্ভবও নয়। শুধু বলতে চাইছি, উপহার দেওয়া যেন কোনও পক্ষের কাছেই বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
সংযমেই স্বস্তি
পুজোয় পার্টি বা প্যান্ডেল হপিং তো চলবেই। কিন্তু মানিব্যাগের দিকটা একটু খেয়াল রেখে। রোজের খরচে লাগাম টানা যায় তা হলেই আপনি চ্যাম্পিয়ন। প্রত্যেক পুজোয় বাজেট থেকে যদি অন্তত ৫,০০০ টাকা আপনি বাঁচাতে পারেন, তা হলে সঞ্চয় কোন জায়গায় পৌঁছতে পারে কল্পনা করতে পারছেন? টানা ২০ বছর যদিও ওই টাকা ইকুইটি ফান্ডে রাখা যায়, তা হলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা জমাতে পারবেন (১২% রিটার্ন ধরে)।
এই টাকা বাঁচানোর জন্য রেস্তোরাঁর বিল বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন। গাড়ি বুক করুন চড়ার অনেক আগে। একেবারে পুজোর মুখে গাড়ি ভাড়া করলে খরচ বেড়ে যেতে পারে।
লগ্নিতে সতর্কতা
পুজোর জন্য সঞ্চয় করার সময়ে লগ্নিতে হাত দেওয়া যাবে না। ঋণ, বিমা, এসআইপির কিস্তির জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা জমা রাখুন, যাতে এ ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি না থাকে। সব সময়ে মাথায় রাখবেন, টার্ম প্ল্যান বা স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম দেওয়ার ব্যাপারটা পুজোর আগে-পরে না হলেই ভাল। জমি-বাড়ি কেনা তো এই সময়ে একেবারেই নয়।
মোট কথা, পুজো হোক আর যা-ই হোক, খরচ সামলানোর এক মাত্র মন্ত্র হল পরিকল্পনা। গোটা বছরের লগ্নি, অবসরের পরিকল্পনা বা অন্যান্য খরচ সুনিশ্চিত করার জন্য যদি আর্থিক পরিকল্পনা করা যায়, তা হলে পুজোর জন্য নয় কেন? তা হলেই তো সহজ হয় জীবনটা!
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)