প্রতীকী ছবি।
গত সাত দশকে দেশে উন্নয়নের কাজ কিচ্ছু হয়নি বলে প্রায়ই কংগ্রেসের উদ্দেশে কটাক্ষ ছোড়েন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল। তেলের চড়া দরকে হাতিয়ার করে সেই প্রসঙ্গ টেনে পাল্টা কটাক্ষ ফেরাল কংগ্রেস। সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী বললেন, ‘‘৭৩ বছরের মধ্যে দেশে পেট্রল-ডিজেলের দর এখন সর্বোচ্চ।’’ রাহুল গাঁধীর উপহাস, ‘‘তেলের দামের অদ্ভুত বিকাশ হয়েছে।’’ সব মিলিয়ে আমজনতার পকেটে জ্বালানির চড়া দামের ছেঁকা নিয়ে কেন্দ্রের সমালোচনায় এককাট্টা হয়ে মাঠে নামল বিরোধীরা।
মোদী সরকারের আমলে তেলে বাড়তি যে উৎপাদন শুল্ক বসানো হয়েছে, তা তুলে নেওয়ার দাবিতে এ দিন ফের সরব হয়েছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি। সরকারি সূত্রের খবর, তেল মন্ত্রক ইতিমধ্যেই নাকি সরকারকে সেই পরামর্শ দিয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, কেন্দ্র আসলে উভয় সঙ্কটে। শুল্ক কমালে রাজকোষ ঘাটতি আরও মাথা তুলবে, না-কমালে বাড়বে দেশবাসীর ক্ষোভের আগুন। বিশেষত তেল সংস্থাগুলি যেখানে স্পষ্ট জানিয়েছে, দাম বাড়তে পারে আরও। কারণ বিশ্ব বাজারে দামি হচ্ছে অশোধিত তেল। এ দিন সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি পেরিয়ে যেতে পারে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৭%। যা সত্যি হলে বাস্তব হিসেব দাঁড়াবে সরকারের অনুমানের দ্বিগুণ।
কলকাতায় বৃহস্পতিবার লিটার পিছু ৭৭.৯৭ টাকার রেকর্ড দরে বিক্রি হয়েছে ডিজেল। এর আগে তা নজির গড়েছে মুম্বইতেও। কলকাতায় আইওসি-র পাম্পে পেট্রল রেকর্ড ছুঁইছুঁই ৮৫.৬৮ টাকায়। তবে দিল্লিতে নতুন নজির গড়ে বিকিয়েছে ৮৪.২০ টাকায়। সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, ২০১৮ সালের অক্টোবরে যখন জ্বালানির দর রেকর্ড গড়েছিল, তখন কেন্দ্র ১.৫০ টাকা করে শুল্ক কমায়। তেল সংস্থাগুলিও দাম কমায় ১ টাকা করে। এখন সেই দাবি ফের জোরালো হচ্ছে।
হিসেবেই কটাক্ষ
• ২০১৪ সালের ২৬ মে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার সময়ে অশোধিত তেলের দর ব্যারেল প্রতি ছিল ১০৮ ডলার। বিনিময় মূল্যের হিসেবে ৬৩৩০ টাকা।
• এখন ৫০.৯৬ ডলার। অর্থাৎ ৩৭২৫.৯২ টাকা।
• ২০১৪ সালে দেশে লিটার পিছু পেট্রল ছিল ৭১.৪১ টাকা, ডিজেল ৫৫.৪৯ টাকা।
• এখন যথাক্রমে (দিল্লিতে) ৮৪.২০ এবং ৭৪.৩৮ টাকা।
• দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুই জ্বালানির দর সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে।
• সাড়ে ছ’বছর আগে লিটার পিছু পেট্রল ও ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক ছিল যথাক্রমে ৯.২০ টাকা এবং ৩.৪৬ টাকা।
• মোদী সরকার এর উপরে পেট্রলে ২৩.৭৮ টাকা ও ডিজেলে ২৮.৩৭ টাকা শুল্ক বাড়িয়েছে।
• এই সময়ের মধ্যে শুল্ক বেড়েছে পেট্রলে ২৫৮% ও ডিজেলে ৮২০%।
• জনতার পকেট থেকে কেন্দ্র ১৯ লক্ষ কোটি টাকা লুট করেছে।
• বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার করলে পেট্রল-ডিজেলের দাম লিটারে নামবে যথাক্রমে ৬০.৪২ এবং ৪৬.০১ টাকায়।
• ২০১৪ সালের মে মাসে ভর্তুকিযুক্ত রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ৪১২ টাকা ছিল।
• মোদী সরকার চুপিসাড়ে তা ৬৯৪ টাকা করেছে।
২০১৪ সাল থেকে একলপ্তে অনেকটা করে তেলের উপর উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে কেন্দ্র। করোনার আবহে জ্বালানির চাহিদা কমায় ফের শুল্ক বাড়িয়ে বাড়তি আয়ের পথ চওড়া করেছিল তারা। সমালোচনা উড়ে এসেছিল তখনই, অর্থনীতির ইঞ্জিনকে সচল রাখতে তেলের হাত ধরেই আয় বাড়াতে হল মোদী সরকারকে? আরও কোনও পথ ছিল না? বিশ্ব বাজারে তলানিতে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও যদি সাধারণ মানুষ পেট্রল-ডিজেলে কম দামের সুবিধা না-পান, তা হলে কবে পাবেন? তেল সংস্থাগুলির যুক্তি ছিল শুল্কে বোঝা বাড়ার ফলেই ক্রেতাদের দাম কমানোর সুবিধা দেওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, লকডাউনের সময় ঘরবন্দি দশায় সেই সুবিধা না-পাওয়ার প্রভাব বোঝা যায়নি। এখন মালুম হচ্ছে। বর্তমানে বেহাল আর্থিক দশার মধ্যে তা পরিবহণের খরচ ও তার জেরে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার আরও চড়া হওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। যার জেরে আখেরে ভুগবেন সাধারণ রোজগেরে মানুষই।
সনিয়া এ দিন বলেন, ‘‘স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম দেশ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এক দিকে অন্নদাতা কৃষক ৪৪ দিন ধরে তাঁদের ন্যায্য দাবিতে দিল্লির সীমানায় আন্দোলন চালাচ্ছেন। অন্য দিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ, সংবেদনহীন ও নিষ্ঠুর বিজেপি সরকার গরিব, কৃষক ও মধ্যবিত্তের কোমর ভাঙতে ব্যস্ত।’’ অশোধিত তেলের দর টাকার হিসেবে লিটারে এখন ২৩.৪৩ বলে দাবি করেছেন তিনি। অভিযোগ, বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে মোদী সরকারের কাছে রাজকোষ ভরাতে সঙ্কটই (তেলের দর) সুযোগ। শুল্ক ও তেলের দামের হিসেব দিয়ে কেন্দ্রকে ব্যর্থতার মাপকাঠিতেও বিঁধতে মরিয়া কংগ্রেস।
করোনা সঙ্কটের মধ্যেও মানুষের জীবনযাত্রাকে এই সরকার কঠিন করেছে— তোপ দেগেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। এ বার দেখার মোদীরা এই সব বাণ সামলান কী করে। তেলের দরই বা কোথায় গিয়ে থামে।