আট-ন’বছর হিমঘরে আটকে থাকার পরে চলতি মাসেই ধুলো ঝেড়ে বেরিয়েছে বানতলা চর্মনগরীর জুতো পার্ক প্রকল্পের ফাইল। অবশেষে তা তৈরিতে পা বাড়িয়েছে রাজ্য। এ বার কেন্দ্রের তরফ থেকেও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলল সেখানে। রাজ্যকে ওই টাকা জোগানোর বিষয়ে কথা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীন শিল্পনীতি ও উন্নয়ন দফতর (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি অ্যান্ড প্রোমোশন বা ডিআইপিপি)। এ জন্য রাজ্যের কাছে প্রস্তাবিত প্রকল্পের রূপরেখাও (কনসেপ্ট নোট) চেয়েছে তারা।
এই কারণেই সম্প্রতি কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজাকে চিঠি দিয়েছে রাজ্যের ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতর। প্রস্তাবিত জুতো পার্ক প্রকল্পের রূপরেখা দ্রুত তৈরির নির্দেশ দিয়েছে তারা। কারণ, ডিআইপিপি-র চূড়ান্ত অনুমোদন নির্ভর করছে সেটির উপরেই।
কেন্দ্রের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির অন্তর্গত চর্মশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের (ইন্ডিয়ান লেদার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা আইএলডিপি) দায়িত্বে রয়েছে ডিআইপিপি। পশ্চিমবঙ্গে প্রস্তাবিত জুতো পার্ক প্রকল্পকেও ওই কর্মসূচির আওতায় আনতে চায় দিল্লি। ২০১৬-’১৭ সালের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে আইএলডিপি বাবদ ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা আছে। এই তহবিল থেকেই রাজ্যের জুতো পার্কের জন্য টাকা বরাদ্দ হওয়ার কথা।
রাজ্যে জুতো পার্ক তৈরির ভাবনা-চিন্তা শুরু ২০০৭ সালে। পরিকল্পনা দানা বাঁধে তার পরের বছর (২০০৮)। কিন্তু মাঝের আট-ন’বছর তা হিমঘরেই আটকে ছিল। সম্প্রতি ওই প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরিতে হাত দিয়েছে ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতর।
বানতলা চর্মনগরীতে জুতো পার্ক তৈরির জন্য ১৩০ একর জমি চিহ্নিত হয়েছে আগেই। লগ্নিকারীও মজুত। সব মিলিয়ে লগ্নির সম্ভাব্য অঙ্ক ১,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু হাতের কাছে সব কিছু প্রায় তৈরি থাকা সত্ত্বেও ২০১৬ সালের আগে প্রকল্পের চাকা গড়ায়নি। পূর্বতন বাম জমানায় (২০০৮ সালে) প্রস্তাবিত পার্কে জায়গা চেয়ে আবেদন জানায় ৩৪টি সংস্থা। ‘কশন মানি’ বাবদ জমাও পড়ে প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার পরে প্রশাসনিক টালবাহানায় প্রকল্প আটকে যায় বলে চর্মশিল্পমহলের অভিযোগ। অভিযোগের তির মূলত শিল্প দফতরের দিকে। এখন অবশ্য চর্মশিল্পের দায়িত্বে ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতর। তার পরেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট শিল্পের দাবি।
গোড়া থেকেই বানতলা চর্ম-নগরীকে তাড়া করেছে দূষণের ভূত। চর্ম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ছ’টি কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) হওয়ার কথা ছিল। রয়েছে চারটি। তাতে মোট ২ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। অথচ সেখানে বর্জ্যের পরিমাণ ৩ কোটি লিটার। সুতরাং ঘাটতি থেকেই গিয়েছে। মূলত এই কারণেই এখানে নতুন কারখানা তৈরির ছাড়পত্র পাচ্ছে না চর্মশিল্প। বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা ঠিকঠাক না-থাকায় নতুন প্রকল্পে ছাড়পত্র দিচ্ছে না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।
বিশ্ব বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে জুতো পার্ককেই তুরুপের তাস হিসেবে দেখছেন স্থানীয় চর্ম ব্যবসায়ীরা। কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের দাবি, এই পার্ক হলে, কমবে উৎপাদন খরচ। জুনেজার মতে, তা একান্ত জরুরি। কারণ, আম্তর্জাতিক বাজারে একেই কম দামের চিনা পণ্যের কাছে মার খাচ্ছে ভারতীয় চর্মশিল্প। তার উপর ওই শিল্প আবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এ রাজ্যে। ২০১৪-’১৫ সালের তুলনায় ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে রফতানি প্রায় ১২% কমেছে। সবচেয়ে মার খেয়েছে জুতো। তা কমে গিয়েছে প্রায় ৫৫%।
অথচ দেশ ও বিশ্বের বাজারে জুতোর কদর সবচেয়ে বেশি। চামড়ার জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জুতো। মোট বাজারের ৫২%। তাই জুতো পার্ক তৈরির জন্য মরিয়া চর্ম ব্যবসায়ীরা। সেই লক্ষ্যেই ১৩০ একর এই পার্কের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজন ১০০ কোটি টাকা।
এখন ২০২ একরে ৩৩২টি কারখানা চলছে বানতলা চর্মনগরীতে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এ বার জুতো পার্কও তৈরি হলে উৎপাদন ও রফতানি বাড়বে। তাই তা তৈরির প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত করার দাবি তুলেছে কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টস। রাজ্যেরও লক্ষ্য, ২০১৭ সালের মধ্যে তা গড়ার কাজ শেষ করা।