লগ্নির পথে কাঁটা তুলে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রায় একশো শতাংশই করেছে পশ্চিমবঙ্গ। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া ৩৭২টির মধ্যে টিক নেই মাত্র দু’টির পাশে। এই সাফল্যের দৌলতে পাঁচ ধাপ এগিয়ে শিল্পবান্ধব রাজ্য হিসেবে ঢুকেও পড়েছে প্রথম দশের তালিকায়। কিন্তু সেই সংস্কারের সুফল হাতেনাতে পাওয়া নিয়ে এখনও যেন কিছুটা সংশয়ী শিল্পমহল। তাই ওই বিষয়ে করা সমীক্ষায় হাত খুলে নম্বর তারা দেয়নি। যে কারণে অনেকেই মনে করছেন, সংস্কার জারি রাখার পাশাপাশি শিল্পমহলের মন ও আস্থা জয়ই আগামী এক বছরে রাজ্য সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দিল্লি দরবারের পাশাপাশি রাজ্য স্তরেও ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার জন্য রাজ্যগুলির মধ্যে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ‘বিজনেস রিফর্ম অ্যাকশন প্ল্যান’-এর ভিত্তিতে তৈরি তালিকা প্রকাশ করে কেন্দ্র। শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের তৈরি এই তালিকায় ২০১৫ সালের কাজের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ছিল একাদশ। ২০১৬ সালে তারা নেমে গিয়েছিল ১৫ নম্বরে। সেখান থেকে এ বার ১০ নম্বরে উঠে এসেছে তারা।
এ বারের রিপোর্ট অবশ্য এক দিক থেকে আগের গুলির থেকে আলাদা। এত দিন রিপোর্ট এবং ক্রমতালিকা তৈরি হত বেঁধে দেওয়া সংস্কারের কাজ শেষ করা নিয়ে রাজ্য থেকে পাওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে। এ বারই প্রথম রাজ্যের দাবির পাশাপাশি বেসরকারি শিল্পমহলের প্রতিক্রিয়াও জানতে চাওয়া হয়েছিল। নাড়ি টিপে বোঝার চেষ্টা হয়েছিল, সরকার যে সংস্কার শেষ করার দাবি করছে, তার সুফল শিল্পের দরজায় পৌঁছচ্ছে কতখানি। দেখা যাচ্ছে, সেখানেই পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। সংস্কারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ যেখানে ৯৯.৪৬% নম্বর ঘরে তুলেছে, সেখানে শিল্পমহলের প্রতিক্রিয়ায় স্কোর মাত্র ৫৩.৬৯%। প্রথম দশে থাকা যে কোনও রাজ্যের সঙ্গে ফারাক অনেকখানি।
এক ঝলকে
• সহজে ব্যবসার পরিবেশ তৈরির নিরিখে রাজ্য প্রথম দশে। তার আগের দু’বছরে স্থান যথাক্রমে ১৫ ও ১১ নম্বরে।
• লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া সংস্কারের কাজ সেরে ফেলায় সাত নম্বরে। ৩৭২টির মধ্যে খাতায়-কলমে কাজ শেষ ৩৭০টিতেই।
• ওই ক্ষেত্রে ঝুলিতে নম্বর ৯৯.৪৬ শতাংশ।
• কাজ বাকি শুধু শিল্পের জন্য জমি দেওয়া এবং তাদের আবেদনের অনলাইন মঞ্জুরিতে।
• কিন্তু সংস্কারের সুফল কতটা হাতেনাতে মিলছে, শিল্পের তরফে সেই শংসাপত্র ভাল নয় এখনও।
• শিল্পের খাতায় রাজ্যের পাওয়া নম্বর মাত্র ৫৩.৬৯। প্রথম দশে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। সবার মধ্যে ১৩ নম্বরে।
• অল্পের জন্য হাতছাড়া ‘টপ অ্যাচিভার্সে’র তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগও।
• আগামী এক বছরে চ্যালেঞ্জ সম্ভবত তাই সংস্কারের সুফলে শিল্পের মন জয়ও।
রিপোর্টে প্রথম তিন রাজ্য এ বার অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা ও হরিয়ানা। শিল্পমহলের ইতিবাচক সাড়ায় তাদের স্কোর ৮০ শতাংশের উপরে। নবম রাজস্থানও শিল্পমহলের কাছ থেকে ৬৪ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ৫৩.৬৯%। সার্বিক স্কোরে পশ্চিমবঙ্গের পিছনে থাকা উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশও শিল্পমহলের কাছে বেশি নম্বর পেয়েছে।
তার উপর আগামী বছর এ ক্ষেত্রে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের শিল্প নীতি ও উন্নয়ন দফতরের সচিব রমেশ অভিষেক বলেন, এ বছর শিল্পমহলের প্রতিক্রিয়াকে আংশিক (তুলনায় কম) গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের তালিকায় তার প্রভাব থাকবে অনেক বেশি। সেই কারণে শিল্পমহল মনে করছে, শুধু খাতায়-কলমে সংস্কারের পাশাপাশি বাস্তবের জমিতে তার প্রভাব নিশ্চিত করাই আগামী এক বছরে রাজ্যের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজ্যের এক শিল্পকর্তা বলছিলেন, এত দিন যে নম্বরের ভিত্তিতে ক্রমতালিকা তৈরি হত কিংবা এ বারও যার প্রভাব বেশি, তা কিন্তু মূলত কিছু অনলাইন ভিত্তিক সংস্কার। কেন্দ্র মূলত নেট মারফত পরিষেবা দেওয়ার বিষয়ে কিছু ক্ষেত্র বেঁধে দেয়। সেগুলি করে ফেলার দাবি জানায় রাজ্যগুলি। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, শুধু তাতে লাল ফিতের ফাঁস আলগা হয় কি? খোলে এক-জানলা ব্যবস্থা? মান্ধাতার আমলের আইনই বা বদলেছে কতগুলি? অর্থাৎ তাঁর ইঙ্গিত, বাস্তবের মাটিতে পরিবর্তন সামান্য বলেই সহজে ব্যবসা নিয়ে এত প্রচারের ঢাক বাজিয়েও লগ্নির দেখা পেতে হয়রান প্রায় সমস্ত রাজ্য।
শিল্পমহলের থেকে কম নম্বর পেলেও, শ্রম নিয়ন্ত্রণে দেশে সেরা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অনেকে বলছেন, এতে আরও পোক্ত হবে পশ্চিমবঙ্গে কর্মদিবস নষ্ট না হওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি। কিন্তু তেমনই আবার ঠাঁই হয়নি প্রথম নয় রাজ্যকে নিয়ে তৈরি ‘টপ অ্যাচিভার্স’-এ।
জমির গেরো কাটেনি। এখনও খামতি শিল্পকে অনলাইন সায়ে। শিল্পবান্ধব তকমা রাখতে রাজ্যের সামনে চ্যালেঞ্জ শিল্পের মন জয়ই।