গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২০২১-২২ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করবেন পয়লা ফেব্রুয়ারি। করোনা অতিমারির আক্রমণে দেশের অর্থব্যবস্থায় যে মন্দা দেখা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে আসন্ন বাজেট বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ২০২০-২১ সালে ৭.৭ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে বলে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দফতর তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে। এই অতিমারির প্রকোপে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, বিভিন্ন ছোট বা মাঝারি শিল্প সংস্থা, হোটেল রেস্তরাঁর মত পরিষেবা বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজেটের মধ্যে দিয়ে দেশের এই আর্থিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের কোনও দিশা দেখাতে পারবে কি কেন্দ্রীয় সরকার? এই প্রশ্নই এখন মানুষের মনে ঘুরছে।
এর উত্তর পেতে হলে আমাদের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাজেটের আগে যে সমস্ত সরকারি পরিসংখ্যান আমাদের হাতে রয়েছে আপাতত তার ভিত্তিতে আমরা বোঝার চেষ্টা করব যে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির অভিমুখ কোন খাতে বইছে।
করোনার প্রকোপে ভারতের অর্থব্যবস্থা গভীর মন্দায় পড়ার আগে থেকেই বৃদ্ধির হার লাগাতার হ্রাস পাচ্ছিল। যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৭.১ শতাংশ যা ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে কমে হয় মাত্র ৩.১ শতাংশ। করোনা অতিমারি ভারতের বৃদ্ধির হারের এই লাগাতার পতনের প্রক্রিয়াকে এক ধাক্কায় আরও তীব্র করেছে। যার ফলে ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতের অর্থব্যবস্থা সঙ্কুচিত হয় প্রায় ২৪ শতাংশ। অতএব, বলা যেতে পারে যে দেশের অর্থব্যবস্থায় মন্দার ছায়া করোনার আবির্ভাবের বেশ কিছু সময় আগে থেকেই ঘনীভূত হচ্ছিল। ২০১৮-১৯ বা ২০১৯-২০ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর নানান দাবি সত্ত্বেও দেশের বৃদ্ধির হারের পতনের প্রক্রিয়াকে আটকানো সম্ভব হয়নি।
সরকার মনে করেছিল যে একদিকে কর্পোরেটদের কর ছাড় দিয়ে এবং অন্যদিকে সুদের হার কমিয়ে এবং ঋণ সহজলভ্য করে এই ক্রমাগত বৃদ্ধি-হার হ্রাসের প্রবণতা আটকাতে পারা যাবে। কিন্তু তথ্য থেকেই স্পষ্ট যে কোভিড অতিমারি ভারতে দেখা দেওয়ার আগেও সরকার তাদের গৃহীত নীতির মাধ্যমে আর্থিক বৃদ্ধির হারের লাগাতার পতনের গতি রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল যে, কোভিড অতিমারির মধ্যে কি সরকারের নীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে, যার মাধ্যমে মনে করার কারণ রয়েছে যে বাজেটে দেশবাসী কোনও নতুন দিশা দেখতে পাবে?
এর উত্তর, না। কারণ সরকার কোভিড অতিমারির মধ্যে যে সমস্ত নীতি গ্রহণ করেছে তার অধিকাংশই আগের নীতির পুনরাবৃত্তি যা কাঙ্খিত ফলাফল দিতে ইতিমধ্যেই বিফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তথাকথিত স্টিমুলাস প্যাকেজে দাবি ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করা হবে। অথচ খতিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে এর মধ্যে ১২.৭০ লক্ষ কোটি টাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণের জোগান বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিবিধ ঘোষণা। কিছু ঘোষণা আগের বছরের বাজেটেই করে দেওয়া হয়েছে যাকে আবার নতুন করে স্টিমুলাস প্যাকেজের অংশ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বা আইএমএফ-এর মতে ভারতে ২০২০-২১ সালে কোভিডের জন্য ফিসক্যাল স্টিমুলাস জিডিপি-র ২.৫ শতাংশ যা জি-২০ দেশগুলির মধ্যে একদম নীচের সারিতে। সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্কের মতো দেশগুলিও আমাদের দেশের থেকে বেশি খরচ করছে কোভিড সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য। অতএব সরকার প্রচুর টাকা খরচ করছে কোভিড অতিমারি জনিত আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করার জন্য তা মানা শক্ত।
ভারতের কন্ট্রোলার জেনারেল অব অ্যাকাউন্টস দফতরের তরফে প্রত্যেক মাসে সরকারের আয় এবং ব্যয়ের হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আপাতত নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে ২০২০-২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের মোট খরচ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে মাত্র ৪.৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই বৃদ্ধির হার ছিল ১২.৮ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে যেখানে কোভিডের নামও কেউ জানত না, সেই বছর সরকার প্রায় ১৩ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি করে আর কোভিড মহামারির দরুণ চরম সঙ্কটের বছরে সরকারের এই যৎসামান্য বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে সরকারের গালভরা স্টিমুলাস প্যাকেজে ঘোষিত নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করা হচ্ছে না।
অতিমারিকে মোকাবিলা করার জন্য লকডাউন দেশের অর্থব্যবস্থাকে বেশ কয়েক মাস স্তব্ধ করে দিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয়েও ভাটার টান। কেন্দ্রের মোট রাজস্ব আদায় (নভেম্বর মাস পর্যন্ত) আগের বছরের তুলনায় কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন করের ক্ষেত্রেও পতন ঘটেছে। যেমন কর-আদায় বাবদ আয় নভেম্বর মাস পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১৪ শতাংশ। কিন্তু সর্বাধিক পতন ঘটেছে কর্পোরেট কর আদায়ের ক্ষেত্রে। কর্পোরেট কর আদায় আগের বছরের তুলনায় কমেছে ৫৫ শতাংশ।
কেউ মনে করতেই পারেন যে লকডাউনের ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অতএব কর্পোরেট কর আদায়ে এই পতন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নভেম্বর ২০২০ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে সেপ্টেম্বর ২০২০ ত্রৈমাসিকে আগের বছরের তুলনায় কর্পোরেট ক্ষেত্রের মোট মুনাফা বৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ, যদিও তার আগের ত্রৈমাসিকে মোট মুনাফার বৃদ্ধির হার ঋণাত্বক হয়ে যায়। তবু ২০২০-২১ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে মুনাফার এই ব্যাপক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক কারণ এই সময় কর্পোরেট ক্ষেত্রের মোট বিক্রির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। একদিকে তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে না, অথচ তাদের মুনাফা বাড়ছে, কী ভাবে সম্ভব? এটি সম্ভব হয়েছে কর্পোরেট সংস্থার খরচ কমিয়ে। একদিকে, কাঁচা মাল কেনার খরচ তারা কমিয়েছে, কর্মী সঙ্কোচনের মাধ্যমে এবং মজুরি কমিয়েও তারা খরচ কমিয়েছে। তদুপরি সরকার ঘোষিত বিবিধ কর ছাড় প্রকল্পের মাধ্যমেও কর্পোরেটদের মুনাফা বেড়েছে। একদিকে দেশের মানুষের আয় কমেছে, কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে নিজেদের গ্রামে পৌঁছতে চেয়েছেন কারণ শহরে তাদের গ্রাসাচ্ছাদন করার মত সংস্থান ছিল না। অথচ কর্পোরেট ক্ষেত্র এই সময় নিজেদের মুনাফা বাড়িয়ে নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এই প্রবণতা দেশের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়েছে।
শুধুমাত্র ৭ এপ্রিল ২০২০ এবং ৩১ জুলাই ২০২০ এই চার মাসের মধ্যে ভারতের ডলার বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। অক্সফ্যামের রিপোর্ট আমাদের জানাচ্ছে যে এই সময় ভারতের ১০০ জন বিলিয়নেয়ারদের যে পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে সেই টাকা দিয়ে ভারতের দরিদ্রতম ১৪ কোটি মানুষকে ৯৪ হাজার টাকা করে দেওয়া যেত। মার্চ এবং অক্টোবর মাসের মধ্যে মুকেশ অম্বানীর সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানাচ্ছে অক্সফ্যামের রিপোর্ট। এই সময় গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬১ শতাংশ। ভারতের বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান ধারাকে করোনা ভাইরাসও ধরাশায়ী করতে পারেনি, বরং সেই প্রক্রিয়া আরও বাড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্রের উপর কর কমিয়েছে, কর আদায় রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। এই বর্ধিত সম্পদের উপর সরকারের কর বসানোর কোনও সদিচ্ছা নেই। অথচ দেশের ধনীতম ১ শতাংশ মানুষের উপর যদি ২-৩ শতাংশ কর ধার্য করা যায় তা হলে বেশ কয়েক লক্ষ কোটি টাকা আদায় করা যাবে যার মাধ্যমে কোভিড জনিত মন্দাবস্থায় দেশের মানুষের হাতে টাকা দেওয়া যাবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বাড়তি খরচ করা যাবে। কিন্তু এই অতিমারির মধ্যেও সরকার তার নীতি থেকে সরে আসেনি। তাই এই নীতিসমূহ যে আসন্ন বাজেটেও ঘোষিত হবে না তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
অন্যদিকে সরকার যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এই মন্দাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে, সেই প্রচেষ্টাও খুব ফলপ্রসূ হয়নি। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ বৃদ্ধির হার লাগাতার কমেছে। শুধু জানুয়ারি ২০২১-এ ঋণ বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে যদিও তা গত বছরের বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ঋণ বৃদ্ধির হার এখনও গত বছরের বৃদ্ধির হারকে অতিক্রম করতে পারেনি। অতএব বিভিন্ন সরকারি ঋণ গ্যারান্টি থাকা সত্ত্বেও প্রচুর মানুষ যে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিচ্ছেন বিষয়টা এমন নয়।
এমনটা না হওয়ার প্রধান কারণ হল চাহিদার অভাব এবং অর্থব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা। আপনি যদি নিশ্চিত না হন যে আপনি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করে আবার ব্যাঙ্কে সুদ সমেত টাকা ফেরত দিতে পারবেন, তবে আপনি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবেন না। যেহেতু অর্থব্যবস্থার সঙ্কট এখনও চলছে, ফলে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা হঠাত্ই বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার বাজারে অসংখ্য মানুষের চাকরি চলে গেছে, তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছ, শিল্প বৃদ্ধির হার নিম্নগামী—এমতাবস্থায় ঋণ নিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর প্রবণতা শিল্পপতিদের মধ্যেও দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অতএব, ফিরতে হবে অর্থনীতির মৌলিক নীতিতে। বাণিজ্য ঘাটতির তোয়াক্কা না করে বাজেটে উল্লেখযোগ্য ভাবে সরকারি খরচ বাড়াতে হবে, যার মধ্যে দিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, যা আবার শিল্পের বৃদ্ধি ঘটাবে। নির্মলা সীতারমন সেই পথে হাঁটবেন কি? ২০২০ সালে গৃহীত সরকারি নীতির প্রেক্ষিতে সেই আশা প্রায় নেই বললেই চলে।
(লেখক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক)