রমেশ বেসরকারি সংস্থার কর্মী ছিলেন। বেতন ছিল মাসে ৭৫ হাজারের বেশি। ফ্ল্যাটের জন্য ৩০ হাজার ইএমআই কাটে প্রতি মাসে। করোনাকালে চাকরি গিয়েছে। চেষ্টা চালিয়ে গেলেও এখনও নতুন কাজ পাননি। কী করবেন?
লাহিড়িবাবু অবসর নিয়েছেন। যে ৫০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন, তার প্রায় পুরোটাই ঋণপত্র নির্ভর বিভিন্ন প্রকল্পে রেখে ৮% সুদে বছরে ৪ লক্ষ টাকা পেতেন। ওটাই ছিল ভরসা। কিন্তু সুদ যে ভাবে কমেছে, তাতে রিটার্নও নেমেছে ৬ শতাংশে। সংসার চলবে কী করে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না।
সুব্রত বসিরহাটের ছেলে। কাজ করতেন মুম্বইয়ে। মাসে পেতেন ১৫-২০ হাজার। গ্রামে বাবা-মাকে তাঁর পাঠানো টাকা থেকেই সংসার, ভাই-বোনের পড়াশোনা চলত। সব বদলে দিয়েছে করোনা। সুব্রত ফিরেছেন গ্রামে। আনাজ বেচে যেটুকু আয় হয়, তাতে সংসার চলে না। ফের কাজের খোঁজে পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষা আর দুশ্চিন্তা, এখন এ দু’টিই সঙ্গী তাঁর।
সুরেশ ও মধু দু’জনই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। ছেলে রোহন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেলেও, তার বিপুল ফি ভরতে তাঁদের আর ঋণ নেওয়ার পথ নেই। কারণ, দু’জনেরই বেতন কমেছে। অতএব শিক্ষা ঋণই ভরসা। পাশ করে বেরিয়ে টাকা মেটাবে ছেলে। অর্থাৎ, রোহনের কর্মজীবন শুরুই হবে মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে।
এ কথা কেন?
করোনা মাত্র কয়েক মাসে আমাদের পৃথিবীটা কী ভাবে উল্টেপাল্টে দিয়েছে, উপরের চারটি ঘটনা তার প্রমাণ। এমন আরও অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। যাঁরা বিপর্যস্ত, তাঁরা যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন দিন-রাত। কিন্তু যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন, তাঁরা কি নিশ্চিত আগামী দিনে এমনই কোনও বিপদ ওঁৎ পেতে থাকবে না? কাজেই আজকের শিক্ষা একটাই, সতর্ক হোন এবং তৈরি থাকুন। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে। কী ভাবে? চলুন একটা উদাহরণ মারফত বুঝে নিই। ধরুন—
রাহুল প্রতি মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে ২৫,০০০ করে টাকা জমাচ্ছেন। ৮% রিটার্ন ধরলে ২৫ বছর পরে হাতে আসবে প্রায় ২.২৮ কোটি টাকা।
তাঁর চাকরি গেল এবং তিনি এক বছর এক পয়সাও জমাতে পারলেন না। তার পরে ফের লগ্নি শুরু করলেন। এর ফলে ২৫ বছর পর গিয়ে একই রিটার্ন ধরে জমবে ২.০৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, এক বছর লগ্নি থমকে থাকায় কম পাবেন প্রায় ২০ লক্ষ।
যদি ধরি তিনি ২৫,০০০ টাকার বদলে ২০,০০০ করে লগ্নি করছেন। পাবেন প্রায় ১.৮৩ কোটি। তা ১০,০০০ বা ১৫,০০০ হলে জমবে আরও কম। সঙ্গে দৈনন্দিন খরচও আছে। তাই সঞ্চয়ের সঙ্গে আপস নয়। মানতে হবে লগ্নির নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম।
না-থাকলে এখনই
বিমা— এই ছোট্ট শব্দটাই বিপদের দিনে ঢাল। তা সে জীবন বিমাই হোক বা স্বাস্থ্য বিমা। আর করোনাকালে এই সুবিধা না-থাকা মানে অন্যায়। অন্য কোনও লগ্নি থাক বা না-থাক, সব থেকে প্রথমে নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষা দিতে বাছুন সেরা প্রকল্পকে।
স্বাস্থ্য বিমা
অনেকেই ভাবেন কোনও রকমে ১-৩ লক্ষ টাকার বিমা করে রাখলেই নিশ্চিন্ত। অথচ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পরে যখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গুনতে হয়, তখন বোঝা যায় আদতে লাভ কিছু হয়নি। নামেই চিকিৎসা বিমা কিনেছেন। খরচ-খরচা, পরিবারের ও নিজের প্রয়োজন হিসেব করে এগোননি। কাজেই প্রকল্পের খুঁটিনাটি জেনে এবং তা কতটা কাজে লাগবে হিসেব করে বিমা করুন। করোনার সময়ে সে কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। অন্য লগ্নিতে দরকারে কাটছাঁট চলবে, স্বাস্থ্য বিমায় নয়।
জীবন বিমা
এই বিমা আপনার অবর্তমানে পরিবারের সুরক্ষা বর্ম। বিশেষত আপনি যদি একমাত্র রোজগেরে হন। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, বর্তমান পরিস্থিতিতে যত কম টাকায় যতটা বেশি কভারেজ বা বিমার সুবিধা পাওয়া যায়, ততই ভাল। যা মিলবে টার্ম পলিসিতে। তবে টার্ম পলিসিতেও সব প্রকল্প সমান নয়। সংস্থা বিশেষে তার সুযোগ-সুবিধা আলাদা হতে পারে। শুধু প্রিমিয়ামের অঙ্ক না-দেখে, আপনার অবর্তমানে পরিবারের কী ভাবে তা কাজে লাগবে, সেটা মাথায় রেখে প্রকল্প বাছুন। কী কী বিষয়ে নজর রাখবেন, তা দেখুন সারণিতে।
সরকারি বিমার সুবিধা
বিমার জন্য বেশি খরচ বওয়া পরিযায়ী শ্রমিক বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে আছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা। যেখানে তুলনায় কম প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্য এবং জীবন বিমার সুবিধা মেলে।
তৈরি করুন তহবিল
পরিযায়ী শ্রমিকই বলুন বা বহুজাতিক সংস্থার কর্মী, চাকরি হারালে নতুন কাজ না-পাওয়া বা আগের অবস্থা না-ফেরা পর্যন্ত ভরসা জমানো তহবিল। যা আগে থেকে তৈরি করে রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে মানুষের পক্ষে তহবিল তৈরি করা কঠিন। কিন্তু ভেবে দেখুন, দিনে যদি ১০ টাকাও জমানো যায়, বছর শেষে হয় ৩৬৫০ টাকা। ১০ বছরে ৩৬,৫০০ টাকা। অর্থাৎ, তিল তিল করে হলেও নিরলস ভাবে তহবিল গড়ে যেতে হবে। আর এর মধ্যেই সরকারের ১০০ দিনের প্রকল্পে বা অন্যান্য জায়গায় কাজের সুযোগ মেলে কি না, তার খোঁজ রাখতে হবে। নিয়মিত আয় থাকলে অন্তত ছ’মাসের সংসার খরচ মজুত রাখতে হবে।
খরচের অভ্যাস পাল্টান
এখন বেশির ভাগ সময়ে ঘরবন্দি থাকায় খরচ কম হচ্ছে। ফলে কিছুটা টাকা এমনিতেই জমবে। তার উপরে আয় কমলে খরচ কমানো ছাড়া উপায় নেই। ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ছাঁটার এটাই সেরা সময়। আমার মতে—
একটা ফর্মুলা মেনে চলতে পারলে ভাল। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে তখন সংসার, ঋণের কিস্তি, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, চিকিৎসা ইত্যাদির পিছনে আয়ের ৫০% খরচ করা উচিত। বাকিটার মধ্যে ৩০% রাখতে হবে দীর্ঘকালীন বিভিন্ন লক্ষ্যের জন্য (যেমন সন্তানের উচ্চশিক্ষা, বিয়ে, অবসরের তহবিল ইত্যাদি)। বাকি ২০% রাখা থাকুক রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া, বিনোদন, বেড়ানো প্রভৃতির জন্য। খুব প্রয়োজন না-হলে ওই ৫০% খরচ কাটছাঁট চলবে না। আবার লগ্নিও চালাতে হবে। তাই শেষ ২০% থেকেই সঞ্চয় বাড়াতে হবে।
কোথায় ঢালব
যে টাকাটা বাঁচানো যাচ্ছে, সেটা কোথায় লগ্নি করলে ভাল, তা নিয়েই এখানে কথা বলব। আমার মতে—
• পিপিএফে নিয়মিত টাকা রাখুন।
• এসআইপি বন্ধ করবেন না।
• যদি এসআইপি বন্ধ করতেই হয়, তা হলেও টাকা তুলে নেবেন না। বরং কয়েক মাস পরে তা ফের চালু করুন। এতে বাজার উঠলে জমা ইউনিটই আপনাকে বেশি টাকা দেবে।
প্রবীণদের জন্য
কম সুদের জমানায় তাঁদের আয় কমছে। ফলে তহবিলকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে কিছু লগ্নি অন্য জায়গায় সরাতেও হতে পারে। আর সে জন্য—
• বেছে নিতে পারেন সিনিয়র সিটিজেন্স সেভিংস স্কিম, প্রধানমন্ত্রী বয়োবন্দনা যোজনার মতো প্রকল্পকে।
• সুদ কমলেও এবং স্থায়ীর বদলে পরিবর্তনশীল সুদ হলেও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পরিচালিত ভারত সরকারি বন্ড লগ্নি হিসেবে খারাপ নয়।
• তবে হ্যাঁ, করোনার সময়ে আপৎকালীন চিকিৎসার জন্য হাতে কিছু টাকা থাকুক। তাই ডেট ফান্ড বা স্থায়ী আমানতে সাধ্য অনুসারে কিছুটা টাকা সরিয়ে রাখতে হবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)