নরেন দেবনাথের বয়স ৭২ ছুঁইছুঁই। আচমকাই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। হাঁটা দূর অস্ত্, বিছানা থেকে উঠতেই পারছিলেন না। ফলে ব্যাঙ্কে গিয়ে লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে পারেননি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আটকে গিয়েছে পেনশন। মাসে মাসে যে টাকাটুকু বিপত্নীক নরেনবাবুর শেষ বয়সে দিনযাপনের একমাত্র সম্বল। যেটা না এলে আটকে যায় ওষুধ-বিষুধ কেনা। মেটানো যায় না আয়া, রাঁধুনি, ঠিকা কাজের লোকের বেতন। শেষমেশ কোনও রকমে ধুঁকতে ধুঁকতে পাশের বাড়ির ছেলেটিকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যেতেই হল তাঁকে। লাইফ সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার পরে ফের চালু হল পেনশন।
আসলে নরেনবাবু জানেনই না, চাইলে বাড়িতে বসেই লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে পারতেন তিনি। শুধু এটাই নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই রকম একগুচ্ছ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে বলেছে ব্যাঙ্কগুলিকে। যদিও আমরা সবাই এ কথা বিলক্ষণ জানি যে, ব্যাঙ্কের কাছে এই সমস্ত সুবিধা চাইলে, তারা বলে লোক কোথায় যে দেব! তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেগুলি দেওয়ার কথা বলেছে সমস্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে। তবে এই সব পরিষেবা না পেলে গ্রাহকের যেমন অভিযোগ জানানোর জোর আছে, তেমনই সেগুলি না দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্কগুলির উপরেও চাপতে পারে জরিমানা।
সত্যিই তো!
সারা জীবন সংসারের জোয়াল ঠেললেন যিনি, আচমকাই তিনি অসহায় হয়ে পড়েন কাজ করার ক্ষমতা কমলে। শরীরের কল-কব্জাগুলো যখন সময়ের নিয়মে কমজোরি হতে থাকে, তখন আর ছুটোছুটি করা সম্ভব হয় না। উল্টে নির্ভর করে থাকতে হয় অন্য কারও উপরে। কিন্তু সব সময় সেটারই বা সুযোগ থাকে কই!
অথচ টাকাপয়সার জন্য এই সব প্রবীণ মানুষেরা ব্যাঙ্কের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল। কারও ভরসা পেনশন। কারও বা সুদ। সেখান থেকেই চলে মাসে মাসে টাকা তোলা, জমা ইত্যাদি। মোদ্দা কথা, যে মানুষটি কাজ থেকে অনেকটা দূরে সরলেন, ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও বেশি বেড়ে গেল। সেই জন্যই ব্যাঙ্কগুলিকে প্রবীণ নাগরিকদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যাতে তাঁদের কোনও ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে পড়ে হয়রান হতে না হয় কিংবা তাঁদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কেউ ঠকাতে না পারে। চলুন জেনে নিই ব্যাঙ্কের গ্রাহক হিসেবে তেমন কী কী পরিষেবা একজন প্রবীণ নাগরিকের পাওয়ার কথা।
ঘরে বসেই পাবেন
বয়স্ক মানুষদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ডোর স্টেপ ব্যাঙ্কিং। অর্থাৎ আপনাকে ব্যাঙ্কে দৌড়তে হল না। উল্টে ব্যাঙ্কই তার বিভিন্ন পরিষেবার পসরা নিয়ে চলে এল আপনার দরজায়। ১৯৪৯ সালের ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রণ আইনেই এর কথা বলা আছে।
সাধারণ ভাবে ৭০ বছরের বেশি বয়সের মানুষেরা এই সুবিধা পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের কর্মী-অফিসারেরা গ্রাহকের বাড়িতে এসে আর্থিক কাজকর্মগুলি মেটানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। যাতে গ্রাহককে যাতায়াতের ঝক্কি পোহাতে না হয়। এই সুবিধা পাওয়া গেলে, ওই প্রবীণ ব্যক্তিকে তখন শুধু সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দিয়ে সই-সাবুদগুলি করে দিলেই চলে। অনেক সময়ে এই কাজের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে অনেক ব্যাঙ্ক।
তালিকায় কী কী
ঘরে বসে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার তালিকায় মূলত যেগুলি পড়ে, তার মধ্যে রয়েছে—
• লাইফ সার্টিফিকেট, কেওয়াইসি সংক্রান্ত নথি, অ্যাকাউন্টে টাকা, চেক ইত্যাদি জমা দেওয়া। পরিবর্তে জমা করার জন্য কত টাকা এবং কী কী নথি দেওয়া হল, তার সমস্তটা বিশদে লেখা একটি রসিদ গ্রাহককে দেবেন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি। যাতে টাকা ঠিক মতো জমা হল কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করা যায়। কোনও নথি হারিয়ে গেলে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে না পারে ব্যাঙ্ক।
• টাকা তোলা।
• ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট তৈরি।
• আয়কর বাঁচানোর জন্য ১৫এইচ ফর্ম জমা দেওয়া।
নিরাপত্তার স্বার্থে
প্রবীণ গ্রাহকের বাড়ি থেকে ব্যাঙ্ক যে টাকা বা চেক সংগ্রহ করবে, ওই দিন বা পরের দিনই তা তাঁর অ্যাকাউন্ট জমা করা বাধ্যতামূলক।
তবে বড় অঙ্কের থোক টাকা গ্রাহকের বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যাঙ্ক কর্মীর পক্ষেও ঝুঁকির। সে ক্ষেত্রে তহবিলের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে জমার জন্য একলপ্তে দেওয়া টাকার অঙ্ক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে ব্যাঙ্ক। কত টাকা বাড়িতে গিয়ে আনা যাবে, তা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের নিজস্ব নিয়মের উপর।
কী ভাবে
ঘরে বসে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন—
• এ জন্য গ্রাহকের কেওয়াইসি ফর্ম ঠিক মতো পূরণ থাকা বাধ্যতামূলক।
• অনেক ক্ষেত্রে এই পরিষেবা পাওয়ার জন্য গ্রাহক ও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের মধ্যে চুক্তি থাকতে পারে। আবার কোনও ব্যাঙ্ক চাইলে তা দিতে পারে চুক্তি ছাড়াই।
• পরিষেবাটি পেতে যোগাযোগ করতে হবে ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে।
• দু’পক্ষের চুক্তি হলে, কোথায় গিয়ে ব্যাঙ্ক কর্মীরা পরিষেবা দেবেন, তার যথাযথ ঠিকানার উল্লেখ থাকা চাই সেখানে।
• এড়ানো সম্ভব নয় এমন কিছু বিশেষ কারণে ওই পরিষেবা না দেওয়া গেলে অবশ্য ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না।
• অনেক সময় এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক বাইরে থেকে এজেন্ট নিয়োগ করে। চুক্তিতে পরিষ্কার উল্লেখ থাকা জরুরি, এজেন্টের ভুলভ্রান্তির জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষই দায়ী থাকবেন।
• এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ চাইলে আলাদা একটি প্রকল্প তৈরি করতে পারেন। তখন প্রবীণ নাগরিকদের তাতে নাম লেখাতে হবে। ঠিক যেমন রাত্রিকালীন চিকিৎসার বিশেষ পরিষেবা পাওয়ার জন্য অনেক সময় আলাদা করে নাম লেখানোর ব্যবস্থা করে অনেক হাসপাতাল। তবে ব্যাঙ্কের ওই প্রকল্পটি তৈরি করতে হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা মেনে। যা চালু হবে ব্যাঙ্কের পরিচালন পর্ষদ অনুমোদন করার পরেই।
• পরিষেবা নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে ব্যাঙ্কিং অম্বুডসমানের কাছে জানাতে পারবেন গ্রাহক।
ফি কত?
অনেক ব্যাঙ্কই বয়স্ক মানুষদের বিশেষ পরিষেবাগুলি দেওয়ার জন্য কোনও টাকা নেয় না। তবে এর কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। চাইলে অনেকে নিতেও পারে। এ জন্য টাকা নেওয়া হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপরে।
যদি ব্যাঙ্কের পরিচালন পর্ষদ ফি নেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়, তবে ঘরে বসে পরিষেবা পেতে ইচ্ছুক গ্রাহকের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতেই সেই ফি-র কথা লেখা থাকতে হবে। যা শুরুতেই দেখে নেওয়া জরুরি। পরিষ্কার ভাবে তার উল্লেখ থাকতে হবে ব্যাঙ্কের ব্রোশিয়োরেও।
বিশেষ কাউন্টার
ভারতে ব্যবসা করছে এমন প্রতিটি ব্যাঙ্কেরই বয়স্ক মানুষদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট একটি কাউন্টার চালু রাখার কথা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলেছে, ওই সব কাউন্টারে অন্য গ্রাহকদেরও পরিষেবা দেওয়া যেতে পারে। তবে বয়স্করা এলে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ঠিক যে রকম ব্যবস্থা রয়েছে বাস বা মেট্রোয় বয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট করা আসনে বসার ক্ষেত্রে।
আসলে প্রবীণ নাগরিকদের যাতে বেশিক্ষণ কাউন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, সে কথা মাথায় রেখেই এই ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সেটা পেনশন তোলা, অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা বা জমা, লাইফ সার্টিফিকেট জমা-সহ নানা ধরনের কাজ হতে পারে।
অ্যাকাউন্ট বদল
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে বলা আছে, কারও বয়স ৬০ পেরিয়ে গেলেই তাঁর অ্যাকাউন্টটিকে প্রবীন নাগরিকের অ্যাকাউন্টে রূপান্তরিত করে দেওয়া উচিত। এর জন্য গ্রাহকের আলাদা করে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের কেওয়াইসি বিধি ঠিকমতো পূরণ থাকা জরুরি।
লাইফ সার্টিফিকেট
যাঁরা পেনশন পান, তাঁদের প্রতি বছর সাধারণত নভেম্বরে লাইফ সার্টিফিকেট দিতে হয়। যে ব্যাঙ্ক থেকে পেনশন তোলা হয় সেখানে। সংশ্লিষ্ট পেনশনভোগী যে বেঁচে আছেন, প্রতি বছর তার প্রমাণ দেওয়াই এর লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কে না গিয়ে অনলাইনে ‘জীবনপ্রমাণ’ পরিষেবার মাধ্যমে সার্টিফিকেট জমা দিতে পারেন প্রবীণ নাগরিক। কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যাঙ্কিং মারফত। তবে বয়স্ক মানুষদের অনেকেই নেট ব্যবহারে তেমন সড়গড় নন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা ঘরে বসে পরিষেবা পাওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া, সম্ভব হলে ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়ে জমা দেওয়ার সুযোগ তো আছেই। সে জন্য আলাদা কাউন্টারও থাকা উচিত। তবে যে ব্যাঙ্কের শাখা থেকে তিনি পেনশন তোলেন, সেখানেই যে তাঁকে সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের যে কোনও শাখায় জমা দেওয়া যায়। ব্যাঙ্কের দায়িত্ব, চটজলদি তাদের কোর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় সেটি নথিভুক্ত করা।