আবৃত্তির কি ক্লাসরুম হয়? কিংবা অন্য কোনও শিল্পের? আমি নিজেই তো সে অর্থে কোনও ক্লাসরুম প্রোডাক্ট নই। নিজের খুশিতে, বাবা-মার হাত ধরেই তো আমার কবিতার পথে চলা শুরু। সেভাবেই তো কবিতা বলা। পরে আমার পাশে পেয়েছি অগ্রজ আবৃত্তিকারদের। কিন্তু এটাই কি আমার ক্লাসরুম নয়? আমি কি এই বিরাট ক্লাসরুমের অংশ নই? চার দেওয়ালের মধ্যে বসে, ৬ ঘণ্টা কবিতা পড়ে, এমনকী সারারাত কবিতার বই পড়েও আবৃত্তি শেখা যায় না, যদি না তার মধ্যে ভালবাসা থাকে। শুধু আবৃত্তি কেন, যে কোনও শিল্পের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি।
কিছু দিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের এক ছাত্রী সব্যসাচী দেবের ‘চণ্ডালিকা’ কবিতাটি আবৃত্তি করছিল। পরে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’র কথা বলতে গিয়ে জানলাম, সে রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ পড়েনি। কেননা ওটা তার সিলেবাসে নেই। কী বলব একে? খণ্ডদর্শন? এই খণ্ডিত বোধ নিয়ে নিয়মিত আবৃত্তির ক্লাস করেও কি খুব বেশি দূর এগোনো যাবে? আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। কিছু দিন আগে একটি প্রতিযোগিতায় এক প্রতিযোগী আবৃত্তি করল ‘মেঘবালিকার জন্যে রূপকথা’। কবির নাম বলল ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি হতবাক। এবং অপ্রস্তুত। জানা গেল সে যে-সিডিটি কিনেছে (সম্ভবত পাইরেটেড) সেখানে কোনও কবির নাম ছিল না। ওর মনে হয়েছে কবিতাটি আমার লেখা। এ ধরনের ভুল শুধু হাস্যকর নয়, বিপজ্জনকও।
অনেকে ভাবেন গলার স্বরটি জোরালো হলে, কণ্ঠস্বরটি ইচ্ছামতো ওঠানো-নামানো গেলেই ভাল আবৃত্তিকার হওয়া যায়। এসব গুণ থাকলে ভাল আবৃত্তি অবশ্যই করা যায়, তবে সবার আগে দরকার কবিতাটিকে ভাল করে নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া। তবেই কবিতাটিকে আমি ছুঁতে পারব। আমি একবার একটি বিশেষ কাজে, ভাল আবৃত্তি করেন কিন্তু তেমন ভাবে নামী নন, এমন কয়েকজনের আবৃত্তির রেকর্ড একজন নাট্যপরিচালককে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সবার গলাই ভাল, কিন্তু কবিতার পালসটা ঠিক কারও গলাতেই পেলাম না।’’ এই যে পালসটা ধরিয়ে দেওয়া, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা, এটাই শিল্পীর কাজ।
আমি কবিতা স্মৃতি থেকে বলি। স্মৃতি থেকে বলাটা আবৃত্তির প্রাথমিক শর্ত। কবিতাপাঠ আর আবৃত্তির মধ্যে এটাই প্রধান তফাত। অনেকেই আমায় প্রশ্ন করেন, আমি কবিতা মনে রাখি কী করে? আমি কবিতা মনে রাখার জন্য আলাদা কিছু করি না। কবিতা আমার স্মৃতিতে রয়ে যায়। আমি কবিতার সঙ্গে বসবাস করি। কবিতাকে চেষ্টা করে মনে রাখার দরকার নেই। ভাল করে পড়লে এমনিই মনে থাকবে। ছোটবেলার কত ঘটনাই তো আমাদের মনে থাকে! কত বর্ষার বিকেল, কিংবা শীতের সন্ধে, বা গ্রীষ্মের দুপুর--- মনে করে দেখুন একটার পর একটা ছবি ফুটে উঠবে। সেগুলো কি আমরা চেষ্টা করে মনে রেখেছি? সেই মুহূর্তগুলো ভাল লেগেছিল বলেই তো মনে গেঁথে গেছে। কবিতাও তাই।
যদিও বারবার বলছি কবিতাকে ভালবাসা, কবিতা বারবার পড়া, একজন ভাল আবৃত্তিশিল্পী হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। তার মানে কি এর বাইরে আর কিছুর দরকার নেই? আমার তো মনে হয়, আছে। আবৃত্তি শিল্প অনেকটা দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত মুনশিয়ানার ওপর। আপনি কোন সময়ে, কোন অনুষ্ঠানে, কী ধরনের কবিতা পড়বেন, আপনার বাছাই করা কবিতার সঙ্গে চারপাশে যা ঘটছে তার যোগ আছে কি না, আপনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে পারিপার্শ্বিক ঘটনাকে ছুঁতে চেষ্টা করবেন কি না,---সেগুলো আপনাকেই ঠিক করতে হবে। যে মাইক্রোফোনটি আপনি ব্যবহার করছেন, তার ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে আপনার গলাটি ঠিকমতো পৌঁছবে, সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। আপনি মঞ্চে কী ভাবে দাঁড়াবেন, দর্শকদের সামনে কী ভাবে নিজেকে তুলে ধরবেন, সেটাও আপনাকেই ভাবতে হবে। এমনকী আপনার সাজপোশাকও। আপনি নিজের টোটালিটিকে কী ভাবে উপস্থাপিত করবেন সেটা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে। আমিও খুঁজেছি। এখনও খুঁজে চলেছি। আমার সেই খোঁজার গন্ধটাই আবৃত্তির ক্লাসরুমে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব।