Baangladesh News

এক সপ্তাহেও নেভেনি টাম্পাকোর আগুন, মৃত বেড়ে ৩৪

গাজিপুরের টঙ্গি বিসিক শিল্প নগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড (টিএফএল) কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও নেভেনি আগুন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদাদাতা

ঢাকা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২৩:২৬
Share:

এখনও কারখানার বিভিন্ন জায়গা থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। ছবি: এপি।

গাজিপুরের টঙ্গি বিসিক শিল্প নগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড (টিএফএল) কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও নেভেনি আগুন। শুক্রবার সকালেও কারখানার বিভিন্ন জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ঝুঁকি নিয়েই উদ্ধারকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে।

Advertisement

ওই কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে সাত জনের পরিচয় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। কারখানার এই ঘটনায় শ্রম আইনে মামলা করা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।

শনিবারের ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সোমবার সকাল থেকে ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা। ওই কারখানার ধ্বংসাবশেষ অপসারণের পুরো কাজ সম্পন্ন করতে দু’মাস সময় লাগতে পারে বলে জানা গিয়েছে।

Advertisement

শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধসে যাওয়া ভবনের জঞ্জাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও গাজিপুর সিটি কর্পোরেশন উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। নিখোঁজদের স্বজনেরা এখন তাঁদের প্রিয়জনের দেহ কিংবা দেহাবশেষের অপেক্ষায় ভিড় করছেন ঘটনাস্থলে। ধ্বংসস্তূপে আরও দেহ বা জীবিত অবস্থায় কেউ আটকা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়েরা। এ নিয়ে গতকাল পুলিশি বাধার মুখেও কারখানার সামনে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা।

এই পরিস্থিতিতে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে একটি দল বুলডোজার ও ভেক্যুয়াম-সহ ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে টঙ্গির ওই টাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় উদ্ধারকাজ করছেন। শুক্রবার সকালেও তাঁরা দু’দিক থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ সরিয়েছেন।

তবে ঘটনাস্থলে কেমিক্যালের একাধিক ড্রাম থাকায় বেশ সতর্কতার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান উদ্ধারদলের কর্মকর্তারা। সেনাসদস্যেরা বৃহস্পতিবার ওই কারখানার ধ্বংসাবশেষ থেকে খাট, চেয়ার, টেবিল, পাতিল, লেপ-তোশক, বই-সহ বিভিন্ন জিনিস উদ্ধার করেছেন।

টঙ্গি মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, বিসিক নগরীর টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় গত শনিবার ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টির বেশি ইউনিটের কর্মীরা টানা চেষ্টা চালিয়ে রোববার সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন।

আগুন নেভাতে ব্যস্ত দমকলকর্মীরা।

আর এর ফলে হতাহতদের খোঁজে কারখানার ভেতরে এখনও তল্লাশি চালাতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা। ভয়াবহ এই ঘটনায় কারখানার বিশাল ভবনের বেশির ভাগই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধসে পড়ার পর ৫ তলা ভবনের অবশিষ্টাংশেও ফাটল দেখা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে বিসিক শিল্প এলাকায় প্রাক্তন সাংসদ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেলে চারটি ভবনের তিনটি ধসে পড়ে। এতে একটি ভবন সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এ ঘটনায় আহত উদ্ধার করা হয়েছে ৩৫ জনকে।

ভয়াবহতা রানা প্লাজার চাইতে বেশি

গাজিপুরের টঙ্গি বিসিক শিল্পনগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা রানা প্লাজার ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম মাহমুদ হাসান। তিনি জানান, কারখানাটির ভয়াবহতা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি। এখানে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমে রয়েছে, তা রানা প্লাজার চেয়েও বেশি। সেনা সদর দফতর থেকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তাঁরা কাজ করছেন বলেও জানান তিনি। মূলত তাঁরা তিনদিক থেকে কাজ করছেন। তবে কারখানার ভেতরে থাকা ইথাইল কেমিক্যালের ড্রামগুলো উদ্ধারকাজের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা এ সব ইথাইলের ড্রাম এক একটা বোমার মতো। কোনও ড্রামে অসাবধানতাবশত খোঁচা লাগলে সেটি বোমার মতো বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি। সে কারণে ইথাইলের ড্রামগুলোকে এড়িয়ে সাবধানতার সঙ্গে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখানকার পুরো কাজ শেষ করতে এক মাসের বেশি সময় লাগবে। এমনকী দু’মাসও লাগতে পারে বলে জানান তিনি।

২০১৩-র ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একিট বহুতল ভবন ধসে পড়ে। এ ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ।

দোষীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা

শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু গত বুধবার সাংবাদিকদের জানান, টঙ্গির টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের তরফে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা করা হয়েছে। দ্রুত তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের নগদ ১৫ হাজার টাকা করে সাহায়্য করা হয়েছে। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি থাকা আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

কারখানার মালিক ও স্ত্রীসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিক মোহাম্মদ জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের বাদি হয়ে টঙ্গি মডেল থানায় একটি খুনের মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারখানার মালিক মকবুল হোসেন ও তার স্ত্রী শেফালি পরভিন-সহ আট জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ, মহাব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মনির হোসেন, ব্যবস্থাপক (সার্বিক) সমীর আহমেদ, ব্যবস্থাপক হানিফ ও উপসহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি। তবে ঘটনার পর থেকে মামলার আসামিরা পলাতক রয়েছে।

দেশের প্যাকেজিং শিল্পের প্রথম কারখানা ছিল টিএফএল

দেশের প্যাকেজিং শিল্পের প্রথম কারখানা টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড (টিএফএল)। টাম্পাকো ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সুইত্জারল্যান্ডের নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানা পণ্যের মোড়ক সরবরাহ করে টাম্পাকো। এ ছাড়া আবুল খায়ের গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ গ্রুপ, ইস্পাহানি, কোকোলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, বিডি ফুডস লিমিটেড, অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, মেরিডিয়ান ফুডস লিমিটেড, ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড, ইউনিভার্সাল ফুডস লিমিটেড, আবদুল মোনেম লিমিটেড, বাংলা-জার্মান লেটেক্স কোং লিমিটেড, শাহ ডেইরি ফুডস লিমিটেড, মোল্লা সল্ট (ট্রিপল রিফাইন্ড) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ভিটালাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রিন্স ফুডস লিমিটেড, হক বিস্কিট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড, জনতা বিস্কিট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড, এ.টি.এন ফুড অ্যান্ড কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড, প্রোম কনজিউমার্স প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড, আল-কাদ ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, নুট্রিয়ন ফুডস লিমিটেড, নূর ফুডস লিমিটেড, গ্লোব বিস্কিট অ্যান্ড ডেইরি মিল্ক লিমিটেড, নাবিস্কো বিস্কিট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড, সিদ্দিক ফুড অ্যান্ড অ্যাগরুবেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আফতাব ফুডস লিমিটেড, দ্যা লালমাই লিমিটেড, আল-আমিন সুইটস, ক্রেকাস লিমিটেডের কার্যাদেশ সরবরাহ করে টিএফএল।

এই তালিকা প্রতি দিন বাড়ছে বলে কোম্পানিটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। টিএফএল বিশ্বমানের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য ও পানীয়জাত পণ্যের ফ্লেক্সিবল মোড়ক প্রস্তুত করে থাকে। এ ছাড়া টিএফএল দেশে তামাকজাত পণ্যের (বেনসন, গোল্ডলিফ সিগারেটসহ) একমাত্র মোড়ক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া টাম্পাকোতে সব ধরনের পেপার ব্যাকড অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, কর্ক টিপিং পেপার, প্লাগ রেপ (মাড়ানো) পেপার, প্রি-প্রিন্টেড টিপিং পেপার, ইনার ফ্রেম বোর্ড ইত্যাদি সব ধরনের পেপার তৈরি করা হয়। এ ছাড়া এখানে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব ধরনের ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিং কাজ করা হয়। দেশের গর্বিত এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিমিষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়াকে সহজে কেউ মেনে নিতে পারছেন না। দুর্ঘটনায় টিএফএলের শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার পরিজনের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে।

শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, কখনও তাঁদের বেতনভাতা বকেয়া রাখা হয়নি। প্রতি মাসের ১ তারিখের মধ্যে তাদের বেতন পরিশোধ করা হত। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের কারখানার পাশে শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ে ফ্রি পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছে।

আরও পড়ুন

সাকিবকে হোটেলে নামিয়ে ফেরার পথে ভেঙে পড়ল কপ্টার, মৃত এক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement