সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা। ছবি: সংগৃহীত।
সুচিত্রা সেনকে স্যার সম্বোধন করতেন গুলজার। ব্যক্তিত্ব মাহাত্ম্যে ব্যতিক্রম। পরিচালক অজয় কর, বাড়ির নাম ‘রমা’ বলেই ডাকতেন। নামটা এতটাই পছন্দ ছিল, ‘হারানো সুর’-এ রমা নামটাই রেখেছিলেন। নাম উচ্চারণে যাতে ছন্দপতন না হয় সে বিষয়ে একশো ভাগ সচেতন থাকতেন। ছবির শেষ দৃশ্যে উত্তম যখন আকুল হয়ে সুচিত্রার বাড়ির দিকে ছুটছেন তখন তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত ‘রমা’ নামটা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। অতৃপ্ত অজয়। শর্ট এনজি করে বললেন, ‘না হবে না’। ডাক পাঠালেন সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে রমা ডাকটা রেকর্ড করালেন। উত্তম ঠোঁট মিলিয়ে শটটা উৎরে দিলেন। বাংলাদেশের পাবনার মানুষ এখন দাবি করছেন, রমা শুধু তাঁদের। তাঁর উপর কারও কোনও অধিকার নেই। ভালবাসার ধর্মই তাই। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরা, এক চুল না ছাড়া।
আরও পড়ুন: কুলায় আর ফিরবেন না লাকি আকন্দ
এতটা আগলে রাখার কারণ অবশ্যই আছে। সুচিত্রার প্রথম আলো দেখা থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর কাটলো যে সেখানে। শুধু বাড়ি নয়, পাড়া-প্রতিবেশীর চোখের মণি। স্কুলের বন্ধুরা রমা বলতে পাগল। সামান্য জ্বরেও প্রবল উৎকণ্ঠা। সুচিত্রা নেই। তাঁর নিত্যসঙ্গীরাও চলে গেছেন। মমতাজের তাজমহলের মতো সুচিত্রার স্মৃতিভারে পড়ে আছে তাঁর বাড়িটা। বাইরেটা তাজমহলের শ্বেত পাথরের মতই সাদা। কিশলয় রং ভেতরের দেওয়ালের। পাবনার হেমসাগর লেনে সুচিত্রাগৃহে মানববন্যা। দর্শনার্থী উপচে পড়ছে। কেন পড়বে না? দীর্ঘ দিন বেদখল ছিল যে। জামাত সেখানে জমিয়ে আসর বসিয়েছিল। সুচিত্রাকে মুছে দিয়ে নিজেদের জাহির করার ব্যস্ততা। সুচিত্রার বাড়িতে হারানো সুর ফিরেছে এত দিনে। এখন সেটা নন্দিত আনন্দনিকেতন।
সুচিত্রা থাকলে বয়স হত ৮৬। ১৯৩১-এর ৬ এপ্রিল তাঁর জন্ম। জন্মদিনে বিশাল কেক কাটা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রুহুল আমিনের উৎসাহে উৎসবের ষোলোকলা পূর্ণ। শুভদিনে পাবনার মানুষ চেয়েছিলেন সুচিত্রা কন্যা মুনমুন, দুই নাতনি রাইমা আর রিয়াকে। ব্যস্ততায় তাঁরা সময় দিতে পারেননি। এলে তাঁদের উপস্থিতির উষ্ণতায় সরগরম থাকত বিশেষ দিনটি।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ।
শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিকদের নজরে বাড়িটা। অধিগ্রহণের পর কী ভাবে আরও মনোরম করা যায় সেই চিন্তা। বাড়িটা আহামরি নয়। মধ্যবিত্তের মাপাজোকা বাসস্থান। নির্মাণে নৈপুণ্য নেই। চোখে পড়ার মতো বাহারই বা কোথায়। তাতে ভালই হয়েছে। থাকলে এটা মকান হয়ে যেত। সুচিত্রার দৈনন্দিন স্মৃতিঘেরা ঘর হতে পারত না, যেখানে দাঁড়িয়ে সুচিত্রার স্মৃতিতে ধন্য হওয়া যায়।
২০১৪-র ১৬ জুলাই সুচিত্রার বাড়িতে সংগ্রহশালা নির্মাণের আদেশ দেয় হাইকোর্ট। প্রশাসনিক জটিলতায় কাজটা থমকে ছিল। সেই সুযোগে দখল নিয়েছিল সমাজবিরোধীরা। তারা আজ অদৃশ্য। সুচিত্রার ছবি সব দেওয়ালে। কলকাতা থেকে তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী আনার চেষ্টা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের বাড়ি দেখার দর্শনীতে রক্ষণাবেক্ষণ আর শ্রীবৃদ্ধির কাজ হবে। সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ যুক্ত বাড়িটির সঙ্গে। দেখেশুনে তাঁরা ঠিক করেছেন, কী ভাবে বাড়িটি আরও আকর্ষণীয় করা যায়। তাঁদের ধারণা, সুচিত্রা সেন শুধু বাঙালির গর্ব নয়। তিনি বিশ্ববন্দিত। যেখানে তাঁর সূচনা আর উত্থান সে জায়গার অবহেলা অমার্জনীয়।