এই বাড়িতেই আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পাশেই দক্ষিণখান থানা এলাকার ‘আশকোনা হাজি ক্যাম্প’। এর পাশেই একটি তিনতলা বাড়ির এক তলায় ছিল জঙ্গি আস্তানাটি। গতকাল রাতে পুলিশ অভিযান শুরুর আগে এলাকার কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, এই বাড়ি আসলে জঙ্গিদের আস্তানা আর রাশি রাশি বোমার ভাণ্ডার।
শুক্রবারই পুলিশের কাছে গোপন সূত্রে খবর আসে নব্য জেএমবি-র সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছে এখানে। অধিকাংশই মহিলা। আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। দেরি করেনি পুলিশ। মধ্যরাতে ওই বাড়িটির চারপাশ ঘিরে বাড়তে থাকে পুলিশের আনাগোনা। প্রথমে সন্তর্পণে। পুলিশের পরিচয় লুকিয়ে। পরে পাঠানো হয় বিশাল বাহিনী। পৌঁছে যায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটি) সদস্যরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াত, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন। রাতভর ঘিরে রাখা হয় বাড়ি।
সকাল হতেই মসজিদের মাইক ব্যবহার করে জঙ্গিদের বাইরে বের হওয়ার আহ্বান জানায় পুলিশ। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ দুই শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে দুই নারী জঙ্গি। পুলিশ ভেবেছিল সহজেই এ পর্বটা মিটে যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা যায়, বিপদ কাটেনি। বরং চরম সংঘাতের লক্ষ্য নিয়ে ভিতরে রয়েছে আরও জঙ্গি। ফের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায় পুলিশ। কিন্তু ভিতর থেকে জবাব আসে সবার কোমরে বাঁধা আছে ‘সুইসাইড ভেস্ট’। পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলেই উড়িয়ে দেওয়া হবে বিস্ফোরণে। টানাপড়েন চলতে থাকে দুপুর পর্যন্ত।
জখম শিশুটি।
দুপুর পৌনে দুটো নাগাদ সাত-আট বছর বয়সী এক শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় এক মহিলাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, “বাড়ির ভিতরে থাকা তিনজনকে আত্মসমর্পণ করতে বললে বোরখা পরা এক নারী ধীরে ধীরে হেঁটে ঘরে থেকে বের হয়। এ সময় তাকে হাত উঁচু করতে বললে সে তা করেনি। এবং বোরখা পরা থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না তার কোমরে সুইসাইডাল ভেস্ট রয়েছে। দরজার কাছে এসে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পুলিশ আহত হয় এবং সাত বছরের শিশুটি আহত হয়।” বোমায় গুরুতর আহত হয় শিশুটি। পরে পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আরও এক জঙ্গিরও মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ দিকে পুলিশের কাউন্টার টোরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “আশকোনার যে বাড়িটিতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে সেই ফ্ল্যাটটির ভেতরে এত বেশি এক্সপ্লোসিভ রয়েছে যে আমরা ভেতরে ঢুকতে পারছি না। আমাদের বম্ব ডেসপোজাল ইউনিট ভেতরে ঢোকার পর এ বিষয়ে জানাতে পারবো।”
আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পর পরে রয়েছে ওই মহিলা জঙ্গির দেহ
আশকোনা হাজি ক্যাম্প এলাকার যে বাড়িটি ঘিরে এত কাণ্ড ঘটে গেল, তার নাম ‘সূর্য ভিলা’। মালিক মোহাম্মদ জামাল হোসেন কুয়েত প্রবাসী। বড় মেয়ে জোনাকি রাসেল কাছেই থাকেন। তিনিই দেখভাল করেন। গত ১ সেপ্টেম্বর মহঃ ইমতিয়াজ আহমেদ নামে একজন নীচতলার ফ্যাটটি দেখতে আসেন। নিজেকে তিনি অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। ভাড়া নিয়ে এখানে তিনি, তাঁর স্ত্রী ও এক শিশুসন্তান থাকবে হলে জানান। একই সঙ্গে জানান, মাঝেমধ্যে এক শ্যালিকাও এসে থাকবেন। ১০ হাজার টাকায় ফ্যাটটি ভাড়া নেন তিনি। দু’দিন পর সপরিবারে সেখানে ওঠেন। শিশুটির বয়স তখন ৪০ দিন। ভাড়া নেওয়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেওয়া, ভাড়াটে সংক্রান্ত ফরম পূরণ সবই করেছে তারা। সে ফর্ম থানায় জমাও দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন জোনাকি। তবে জোনাকি জানাচ্ছেন, পরিবারের কেউ বাইরে প্রায় বেরোত না। প্রশ্ন করলে নানা অছিলায় এড়িয়ে যেত প্রসঙ্গ। তবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁদের নিজেদের বাড়িতেই গড়ে উঠেছে জঙ্গিদের আস্তানা। বলেছেন জোনাকি।
আরও পড়ুন: আচমকা দরজা খুলে বেরিয়ে মহিলা জঙ্গির আত্মঘাতী বিস্ফোরণ