না ফেরার দেশে চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক শওকত আলি।
‘পিঙ্গল আকাশ’, ‘অপেক্ষা’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘অবশেষে প্রপাত’, ‘জননী ও জাতিকা’, ‘জোড় বিজোড়’, ‘ওয়ারিশ’, ‘বাসর ও মধুচন্দ্রিমা’ এমন অসংখ্য উপন্যাস বর্তমান ও ভাবী প্রজন্মের পাঠকদের জন্য রেখে, না ফেরার দেশে চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক শওকত আলি।
ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনির জটিলতা ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে গত ৪ জানুয়ারি ঢাকার ল্যাব এড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। প্রথমে আইসিইউতে রাখা হলেও, পরে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল। এর পর ১৬ জানুয়ারি তাঁকে ল্যাব এড থেকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে।
সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন, আকুল প্রার্থনা ছিল অনুরাগীদের। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হল না। রোগের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যেতে হল তাঁকে। বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
আরও পড়ুন:
রোহিঙ্গাদের ফেরানো শুরু হবে না এখনই
হাসিনার দফতরের পাশেই হত তিন জঙ্গি
অবিভক্ত ভারতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন শওকত। শ্রীরামপুর মিশনারি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কলকাতার অবস্থা খারাপ হওয়ায়, ১৯৪১ সালে সপরিবারে ফের রায়গঞ্জে ফিরে যায় তাঁর পরিবার। সেখানে একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন তাঁর মা। ডাক্তারি পেশা শুরু করেন বাবা। অন্য দিকে রায়গঞ্জ করোনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন শওকত। ১৯৫১ সালে তিনি করোনেশন স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে তিনি দিনাজপুরের সুরন্দ্রনাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন।
ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু নানা কারণে কলা বিভাগে পড়তে বাধ্য হন। ছাত্র জীবনেই জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের কথা- সেই সময়ে শরীরে রক্ত টগবগে, জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। এর পরই মায়ের মৃত্যু। ১৯৫২ সালে শওকত আলি তার ভাই-বোনদের নিয়ে সে সময়ের পূর্ব বাংলার দিনাজপুরে চলে যান।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫৫ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ-তে ভর্তি হন ও ১৯৫৮ সালে এমএ পাশ করেন।
১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাতে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শওকত আলি। এর পরই সুযোগ আসে শিক্ষকতার। ১৯৫৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দিনজাপুরের একটি স্কুলে। ১৯৬২ সালে জগন্নাথ কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন তিনি। এর আগে বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিনে লেখালেখি চালালেও ঢাকায় আসার পর লেখালেখির প্রসার ঘটে তাঁর। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।
বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করেছেন। দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তার অনেক গল্প, কবিতা ও শিশু সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে।
শওকত আলি তার ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনকাল, দেশভাগ আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মর্মন্তুদ ছবি এঁকেছেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে তিনি তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের বঞ্চনার কথা তুলে এনেছেন, পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন শোষকের বিরুদ্ধে ‘অচ্ছুৎ’ সম্প্রদায়ের বিপ্লব-বিদ্রোহের চিত্র।
‘উন্মুল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’-সহ বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন শওকত আলি।
সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। ১৯৭৭ সালে পেয়েছেন হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার। উপন্যাসত্রয়ী ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’-এর জন্য শওকত আলি ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। এর পর কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে বন্দি করে জেলে পাঠায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা।
লেখালেখি এবং শিক্ষকতা করেই জীবন পার করেছেন শওকত আলি। সরকারি সঙ্গীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। অবসর নিয়ে ঢাকার হাটখোলায় নিজের বাড়িতেই থাকতেন। বাঙালি সমাজব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তন নিয়ে যে ক’জন লেখক কাজ করেছেন, শওকত আলি তাঁদের অন্যতম। বিভিন্ন দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের চিন্তাধারার পরিবর্তনও উঠে এসেছে তার লেখায়।