পড়ে রয়েছে তামিম আহমেদের দেহ। —নিজস্ব চিত্র
ফেসবুকে তার নাম ‘বাংলার বাঘ’। আন্তর্জাতিক আইএস জঙ্গিরা চিনত বাংলাদেশ শাখার প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ নামে। গুলশনের হোলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ইদের জমায়েতে হামলা ছাড়াও গত দেড় বছরে একের পর এক চোরাগোপ্তা খুনে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে পুলিশ বার বার তার কথাই বলে এসেছে। শনিবার নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পুলিশি অভিযানে মারা পড়েছে সেই জঙ্গি তামিম আহমেদ চৌধুরী। পুলিশের জঙ্গি-দমন শাখার বিশেষ কমিশনার সানোয়ার হোসেনের দাবি— তামিমের মৃত্যুতে বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের মেরুদণ্ড ভেঙে গেল। ২০ লক্ষ টাকা মাথার দাম ঘোষণা করে হয়েছিল তামিমের।
পুলিশি অভিযান শেষ হওয়ার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ দিন দুপুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তামিমের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, গুলিতে তার দুই সহযোগীও মারা গিয়েছে। তাদের ছবি প্রকাশ করা হলেও পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক জানিয়েছেন, তামিম ছিল জঙ্গি সংগঠন ‘নয়া জেএমবি’-র সামরিক শাখার প্রধান। জঙ্গিদের উৎসাহ দিতে সে নিজে তাদের গুলশনের রেস্তোরাঁ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতেই তাঁরা খবর পান, ওষুধ ব্যবসায়ী পরিচয়ে তামিম পাইকপাড়ার একটি বাড়ির তিনতলায় ভাড়া থাকছে। এর পরে সকালে ঢাকা থেকে জঙ্গি-দমন শাখার বাহিনী এলাকা ঘিরে ফেলে। অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত বিশেষ ‘সোয়াট’ বাহিনীও আসে। জঙ্গিরা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে সাড়া না-দেওয়ায় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’ নামে অভিযান চালায় পুলিশ।
পুলিশের আইজি জানিয়েছেন, প্রথমে মাইকে ঘোষণা করা হয়, আত্মসমর্পণ না-করলে পুলিশ গুলি চালাবে। কিন্তু জঙ্গিরা তার জবাব দেয় গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে। ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দেয় তারা। ঘণ্টা খানেক চলে গুলির লড়াই। এর পরে গুলিবর্ষণ কমে এলে সোয়াট বাহিনী দোতলায় উঠে যায়। সেখানে তিন জঙ্গির গুলিবিদ্ধ দেহ মেলে। তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড ও কিছু ধারালো অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে জঙ্গিদের ডেরা থেকে। কিন্তু জঙ্গিরা তাদের একটি ল্যাপটপ, কয়েকটি মোবাইল সিম কার্ড ও নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে।
পুলিশ জেনেছে, আগাগোড়া পাকিস্তানের সমর্থক তামিমের পরিবার আদতে সিলেটের বাসিন্দা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তামিমের বাবা কানাডায় চলে যান। সেখানে বড় হওয়া তামিম ২০১৩-র ৫ অক্টোবর ঢাকায় আসে। মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়ে সে দু’এক বার ভারতেও গিয়েছে বলে পুলিশ খবর পেয়েছে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর বসে যাওয়া ক্যাডারদের উজ্জীবিত করে সে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। ধনী পরিবারের তরুণদের টানে সংগঠনে। এই সময়েই তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় আর এক জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহিরের প্রধান জিয়াউল হকের। জিয়া সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর। তার অনুগামীরা প্রায় সকলেই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তামিম ও জিয়া, দু’জনে আইএস-এর নামে বাংলাদেশে নাশকতা শুরু করে। পুলিশ জেনেছে, বিদেশের একটি দূতাবাস থেকে তারা নিয়মিত অর্থ পেয়েছে। দেশের কিছু সরকার-বিরোধী মহলও তাদের অর্থ জুগিয়েছে। প্রথমে কয়েক জন বিদেশি নাগরিক, পুরোহিত ও ধর্মগুরুকে খুনের পরে গুলশন ও শোলাকিয়ায় দু’টি বড় হামলার চক্রান্ত করে জিয়া ও তামিম। গুলশনে ২০ জন বিদেশিকে হত্যা করা গেলেও শোলাকিয়ার হামলা রুখে দেয় পুলিশ। তার পর থেকে গা ঢাকা দেয় তামিম ও জিয়া।
পুলিশের দাবি, তামিম নিকেশ হওয়ার পরে জিয়াকে ধরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।