নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর (জেএমবি) বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। প্রথম রাতের অভিযানে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে ঢাকা ও রাজশাহীতে তিন জেএমবি সদস্য নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম-সহ কয়েক জনের রহস্যজনক খুনের জেরে এই অভিযানে নেমেছ পুলিশের যৌথদল। জানা গিয়েছে, প্রথম রাতের অভিযানে ঢাকায় খতম হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যার প্রধান ঘাতক জয়পুরহাটের জেএমবি নেতা তারেক হোসেন মিলু ওরফে উসমান এবং বগুড়ায় শিয়া মসজিদের হামলার নেতা দিনাজপুরের ভয়ঙ্কর জঙ্গি সুলতান মাহমুদ ওরফে রানা ওরফে কামাল। আর ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে মারা গিয়েছেন জামালউদ্দিন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘আমরা জেএমবি-সহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোকে এই বার্তা দিতে চাই যে এক জন পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে হত্যা করে তারা যদি মনে করে পুলিশকর্মীদের ভয় পাইয়ে দেওয়া যাবে তা হলে তারা ভুল করবে।’’ পুলিশের ধারণা, জেএমবি-র ভিতরে এখন জামাত শিবিরও সক্রিয় রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজশাহীতে বন্দুকযুদ্ধে সোমবার রাতে নিহত জামালউদ্দিনের সহযোগী তারেক আজিজ ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিছু দিন আগে এক আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে গিয়ে মারা যায় তারেক। পুলিশের হাতে আটক তারেকের মা তসলিমা বেগমও স্বীকার করেন, তারেকের বাবা আবু সালেকও জামাতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
পুলিশ জানায়, ঢাকার পল্লবী এলাকার কালশীতে পুলিশের সঙ্গে সোমবার গভীর রাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তারেক হোসেন মিলু ওরফে উসমান এবং সুলতান মাহমুদ ওরফে রানা ওরফে কামাল, আর রাজশাহীর গোদাগাড়ির ফরাদপুর চাপড়া গ্রামে নিহত হয় জামালউদ্দিন। পুলিশের মতে, নিহতেরা নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি’র সক্রিয় সদস্য।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, অভিযানে নিহতেরা বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করেছে। সংখ্যালঘুদের জীবনরক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করতেই টার্গেট কিলিং-এর পথ বেছে নিয়েছে জঙ্গিরা। সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিতরাও জঙ্গিদের টার্গেট হচ্ছেন।
ঢাকায় নিহতদের পরিচয় জানিয়ে মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যা ও দিনাজপুরের কাহারোলে জঙ্গি হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল জয়পুরহাটের জেএমবি নেতা তারেক হোসেন মিলু ওরফে উসমান। আর বগুড়ায় শিয়া মসজিদের হামলায় নেতৃত্ব দেয় দিনাজপুরের কুখ্যাত জঙ্গি সুলতান মাহমুদ ওরফে রানা ওরফে কামাল।
গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে (৫০) কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। ওই দিন সকালে সাড়ে ৭টা নাগাদ তিনি বাড়ি থেকে বের হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। প্রায় ৫০ গজ যাওয়ার পর বোয়ালিয়া থানার শালবাগান এলাকার বটতলা মোড়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। দুর্বৃত্তেরা ধারাল অস্ত্র দিয়ে পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে কোপ দেয়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তা ছাড়া, গত বছরের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর-চককানু গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের আল-মোস্তফা জামে মসজিদে নমাজ পড়ার সময় অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিবর্ষণে মোয়াজ্জিন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরও তিন জন।
আরও পড়ুন:‘ছোট’ অপরাধ ঠেকাতে ই-ভ্রাম্যমান আদালত, আইনও কড়া হচ্ছে বাংলাদেশে
বাংলাদেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পিছনে জঙ্গিদের বিশেষ মোটিভ রয়েছে উল্লেখ করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, দেশে জঙ্গি তৎপরতার পিছনে জামাত-শিবিরের সরাসরি হাত রয়েছে। একই অভিমত রাজশাহী পুলিশেরও। পুলিশকর্তারা জানান, ২০১৫-র ২৫ ডিসেম্বর বাগমারার আহমদিয়া মসজিদে জুমার নমাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় তারেক আজিজ নামে এক জঙ্গি নিহত হয়। পরে তারেকের সহযোগী জামালকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে রাজশাহী জেলা পুলিশ। সোমবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ রাজশাহী পুলিশের একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাবুডাইং এলাকা থেকে জামালকে গ্রেফতার করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গোদাগাড়ির ফরাদপুরে অভিযান চালানোর সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জামাল। এর আগে বাগমারার মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জামাল পুলিশকে জানায়, আত্মঘাতী হামলাকারী তারেক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রূপনগর গ্রামের আবু সালেকের ছেলে। সে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিল। পরে জামালের বক্তব্যের সূত্র ধরে রাতেই তারেকের মা তসলিমা বেগমকে আটক করে পুলিশ। তসলিমা বেগম দাবি করেন, তাঁর ছেলে শিবির এবং স্বামী জামাতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, জেএমবি-র কথা তিনি জানতেন না। তাঁর ধারণা, ছেলের কিডনির চিকিৎসায় সহায়তার জন্য টাকা দেওয়ার কথা বলে তারেককে দলে ভিড়িয়েছিল জেএমবি।