বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি ডেরায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পেশ করছেন বিএনপি নেতারা। গত রবিবার সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি দাবি করেছেন, ‘‘জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকারের নাটকীয় কথাবার্তা মানুষকে জিজ্ঞাসু করে তুলেছে। আসলে কী ঘটে চলছে, সেটি এখন জনগণের কাছে মোটেও স্পষ্ট নয়।’’ বাংলাদেশের জঙ্গি ডেরায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দল নানা প্রশ্ন তুলেছে। যদিও সিলেটের জঙ্গি ডেরায় অভিযান নিয়ে দলের নেতারা বিভিন্ন মন্তব্য করলেও দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’-এ জঙ্গি দমনে সফল অভিযান পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর প্যারা কম্যান্ডো-সহ বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তবে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘দু’-একটি অভিযানের সাফল্যে আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই।’’ তিনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সমস্যাকে জাতীয় ভাবে মোকাবিলা করতে সবাইকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। খালেদা বলেছেন, ‘‘কেবল দমন অভিযান চালিয়ে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদের শেকড় পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়।’’
খালেদা তাঁর বিবৃতিতে নিজের শাসনকালে জঙ্গিবাদ দমনে অবস্থানের কথা তুলে বলেছিলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশব্যাপী এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়ে আমরা দায়িত্ব নেবার পর আমাদের সরকারও জঙ্গিবাদের এই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। আমরা কঠোর হাতে তা দমন করি। খালেদা এ কথা বললেও বাস্তব হল, ২০০১ সালের জোট সরকারের আমলে রাজশাহী অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল জেএমবি। এই জেএমবি-র সশস্ত্র মিছিল হয়েছে প্রশাসনিক প্রহরায়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির নেতৃত্বের জোটেই এখনও রয়েছে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত দল জামাত। বিএনপি জামাতের দেশ শাসনকালে যখন বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জেএমবির উত্থান ঘটল তখন সাংবাদিকদের যে দলটির নেতা মতিউর রহমান নিজামি বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই নামে কিছু নাই, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি।’ পরে বাংলা ভাই গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে যুদ্ধপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নিজামির দল এই নিয়ে আর কোনও কথা বলেনি। অন্য দিকে ফরিদপুরে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অত্যাচার করেছে। সারা দেশে তারা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, বাংলা ভাই সে সময় বিএনপি-ই সৃষ্টি করেছিল।
আরও পড়ুন, মার্কিন বিদেশ দফতরের সাহসী ১৩ জন নারীর তালিকায় বাংলাদেশের শারমিন
নিকট অতীতে জঙ্গিরা পুলিশের কাছ থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেওয়া-সহ সারা দেশে জঙ্গি উত্থান নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির অডিও বার্তা ও পরবর্তী সময়ে গাজিপুরের ত্রিশালে জঙ্গি হামলায় পুলিশ নিহত এবং জেএমবি সদস্যদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিতে বিএনপি-র সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে মতিয়া চৌধুরী সে দিন বলেছিলেন, ‘২০০২ সালের ২০ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিনে এলেক্স প্যারি একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানে বলা হয়, ‘২০০১ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ১৫০ জন আফগান তালিবান ও আল-কায়েদা জঙ্গি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তালিবান শীর্ষ নেতা ফজলে করিম ভারতের পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলে তিনি স্বীকার করেন, ২১ ডিসেম্বর আরও ১০০ তালিবান ও আল-কায়েদা জঙ্গি চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, ওই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক দূতাবাসের বরাত দিয়ে লিখেছে, লাদেনের ডান হাত মিশরীয় নাগরিক জাওয়াহিরি চট্টগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং কয়েক মাস থাকেন। জাওয়াহিরি এক জন মৌলবাদী নেতার বাড়িতে অবস্থান করেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে জঙ্গিদের অবস্থান আছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। যেহেতু ২০০১-এর অক্টোবরে নির্বাচনে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন এবং তাঁর জোটের দু’টি দল তালিবানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং একটি দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তালিবান আল-কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে। খালেদা জিয়া নিজে দু’বার অস্বীকার করলেও তাঁর প্রশাসন সরকারের মধ্যে তালিবান ও আল-কায়েদা সদস্য থাকার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী মোর্শেদ খানও উদ্বেগ প্রকাশ করে টাইম-কে বলেছিলেন, দলের মধ্যে এরা থাকলে (তালিবান) কম ক্ষতিকর। কারণ তারা দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে থাকবে।’
হোলি আর্টিজান বেকারির হামলার পর থেকে দেশে বেশ কিছু জঙ্গি আস্তানা তছনছের ঘটনা ঘটলেও সে সময়েও অভিযানগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। একই সঙ্গে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলটির কোনও কর্মসূচি না দেওয়ায় সরকারে থাকা আওয়ামি লিগ যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামাতের সঙ্গে বিএনপি-র জোটে থাকা ও ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
ঢাকা বিমানবন্দর।
ঢাকা বিমানবন্দরের কাছেই পুলিশ বক্সের সামনে বিস্ফোরণে এক ব্যক্তির প্রাণ হারানোর পর দিন সিলেটে একটি জঙ্গি আস্তানায় সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালীন শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়া পল্টনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, সরকার এটার (জঙ্গিবাদ) আসলে সমাধান করতে চায় না। তারা এটাকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। জঙ্গিবাদ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না হয়, সেই আহ্বান আমরা জানাচ্ছি।” বিএনপির শীর্ষ নেতা রিজভি আহমেদ ভারতের সঙ্গে চুক্তি থেকে দৃষ্টি সরাতে জঙ্গিবাদ, জঙ্গি দমনের নামে নাটক করা হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “আপনারা চট্টগ্রাম শেষ না হতে আশকোনার নাটক, এটা শেষ না হতে খিলগাঁও নাটক। এর দুইদিন যেতে না যেতে আজকে সিলেটে মহিলা জঙ্গির কথা বলা হচ্ছে। কারণ দৃষ্টি ওদিকে দাও, দৃষ্টি দিল্লির দিকে দিও না, দৃষ্টি হিন্দুস্তানের দিকে দিও না। দৃষ্টি জঙ্গি নিয়ে থাক, আমরা এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতের অঙ্গীভূত করব। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভারতের অধীনস্থ করব।”
এ দিকে বিএনপিকে জঙ্গিবাদের ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ বলে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন সাভারে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের কাদের বলেছিলেন, ‘‘বিএনপি এই জঙ্গিদের মদত দিচ্ছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তা না হলে তাদের এতটা আস্কারা পাওয়ার কথা ছিল না।’’ বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের পাল্টা আওয়ামি লিগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিএনপিকে ‘জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ আখ্যা দিয়ে এক আলোচনায় বলেছেন, ‘দালাল আইন বাতিল করে যাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল তারাই আজকে উগ্রবাদী গোষ্ঠী, তারাই মৌলবাদী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। হানিফ বলেছেন, “আজকে সকল উগ্রবাদ জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিএনপি জড়িত। জঙ্গির প্রতি বিএনপির এত মায়া কেন? তাদের রক্ষা করতেই বিএনপি নেতারা আজকে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন।’’ ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার ‘জঙ্গিবাদ ইস্যু’কে অতিরঞ্জিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ।
আরও পড়ুন, ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করতে পারবে না ২৮টি কোম্পানি
মিরপুর বধ্যভূমিতে ২৫ মার্চ ১৪ দলের গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় আওয়ামি লিগ নেতৃত্বাধীন জোটের মুখপাত্র আওয়ামি লিগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহম্মদ নাসিম বলেন, “চক্রান্তকারীরা এখনও তৎপর রয়েছে। পাকিস্তান পরাজিত হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের দোসররা পরাজয় না মেনে সব সময়ে দেশের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি বলেই এখন বাংলাদেশে জঙ্গিরা হানা দেয়। ওরা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়।”
বিএনপি-র সঙ্গে জোটে জামাতের থাকার বিষয়টি বিএনপি নেতারা ‘নির্বাচনের জোট’ বলে চিহ্নিত করলেও যে দলটি বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে, অংশ নিয়েছে গণহত্যায়, সেই দলটি কেনই বা এত অপরিহার্য? এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে দামি প্রশ্ন হিসেবে উঠে আসছে।