পড়ে রয়েছে আত্মঘাতী জঙ্গি শারিকার দেহ।—ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রং গাঢ় হচ্ছে। শেকড় ছড়াচ্ছে গভীরে। তিমিরে ঢাকার প্রয়াস ব্যর্থ করে অবাধ নির্বাচন হচ্ছে। ভোটের পর ভোটে ফুটছে আকাঙ্ক্ষার আলেখ্য। পল্লবিত রাজনীতির ডালপালা। পছন্দ অপছন্দের দোলা। জয় পরাজয়ের আনন্দ বিষাদ। হারলে দুয়ো দেওয়াটা দুঃখের। আদতে হারছে না কেউই। সবাই মিলেই জেতাচ্ছে গণতন্ত্রকে। উচ্ছ্বাস ভোটের উৎসবে। ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে যে ভোট হল সেখানেও তাই। সারিবদ্ধ উৎসাহী মানুষের ভিড় পোলিং বুথে। প্রতিপক্ষরা আত্মগোপনে। অন্ধকার দিন কাটাচ্ছে। চাইলেও আলোয় ফিরতে পারছে না। মরতে চাইছে পরাজয়ের জ্বালায়। অন্ধকারের জয় চেয়েছিল। আঁধারকে আলো ঠাওরেছিল। তা কী করে হয়! ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে আশকোনা অঞ্চলে সূর্যভিলা বাড়িটার নীচের তলায় আস্তানা গেড়েছিল হতাশ জঙ্গিরা। বড়দিনের আগের দিন ২৪ ডিসেম্বর 'অপারেশন র্যাপল-২৪' চালানো হয় তাদের বিরুদ্ধে। জঙ্গিদের সামনে খোলা ছিল দুটি রাস্তা। আত্মহনন নয়ত আত্মসমর্পণ। চারজন ধরা দিয়েছে। দু'জন আত্মঘাতী।
নিজেকে শেষ করার উদ্দেশ্যটা অস্পষ্ট। জঙ্গি সুমনের স্ত্রী শারিকা স্বেচ্ছামৃত্যু বরণের আগে বলেছে, জান্নাতে যাচ্ছি। পৃথিবীর কোনও মোহই কিছু করতে পারবে না। কথাটার মানে কী। ধরনীর পরে কীসের অভিমান। তার বয়স মাত্র ৩০। কতটুকুই বা জেনেছে, বুঝেছে। জন্মেই যে আলো দেখেছে, যেখানে বড় হয়েছে, স্বপ্নের জাল বুনেছে, সেখানে দাঁড়িয়েই বলছে, আমি চললাম। মাটি ছেড়ে স্বর্গে। সেটা কেমন জানে না শারিকা। অপার্থিব আনন্দের ইশারা। কে বা কারা বোঝাল এ সব কথা! বাঁচার চেয়ে মরা ভাল এমন ধারণা কী করে জন্মায়। এ তো মানসিক ব্যাধি। মনোবিদকে দিয়ে কাউন্সেলিং করালে হয়ত ঠিক হত। মিথ্যে মায়ায় হারিয়ে না গিয়ে সত্যিটা খুঁজে পেত।
'শ্যালোজ' ছবিটা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। গল্প জুড়ে মধ্যবয়সী নারী ন্যান্সির একক সংগ্রাম। সমুদ্রে হাঙরের মুখে। হিংস্রতায় ছিঁড়ে নিচ্ছে তার ঊরুর মাংস। রক্তে নীল জল লাল। থামছে না, মরছে না ন্যান্সি। তীরে ফিরছে। সুস্থ হয়ে আবার যাচ্ছে সাগরে। এবার একা নয়, সঙ্গে কিশোরী কন্যা। অপ্রতিরোধ্য ঢেউয়ের সঙ্গে দুর্বার লড়াই। প্রকৃতির সঙ্গে দ্বৈরথে জিতছে জীবন। প্রকাশ করছে বেঁচে থাকার অবর্ণনীয় মাধুর্য। নারী পারে সমুদ্র থেকে মহাকাশ জয় করতে। শারিকাও পারত, যদি ঠিক পথে থাকত। বিপথে গিয়েই বিভ্রম। সুন্দর পৃথিবীকে অস্বীকার। এর চেয়ে মর্মান্তিক কী হতে পারে। জঙ্গি তানভির কাদেরির ১৪ বছরের ছেলে শহিদ কাদেরি, যার ডাক নাম আদর, তারও মৃত্যু একই ভাবে। স্বেচ্ছায় মৃত্যুতে সঁপেছে নিজেকে। দুনিয়ার কিছুই দেখল না, বুঝল না, শুনল না, চলে গেল কৈশোরে। সব প্রাণই মূল্যবান। নিজের প্রাণ নেওয়াও তো অমার্জনীয় অপরাধ। কোমরে 'সুইসাইড ভেস্ট' বেঁধে মৃত্যুকে আহ্বান।
নারী জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের সন্তানরাও থাকছে। মৃত শাকিরার কন্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আরোগ্য লাভের আগেই মাকে খুঁজছে। পাচ্ছে কোথায়। নিহত জঙ্গি জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা তার মেয়েকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষ্ণাও তার মেয়ের হাত ধরে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে। মা জঙ্গি, মেয়েরা অসহায়। কোন অপরাধে তারা অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে জঙ্গিরা জব্দ। এগনোর রাস্তা বন্ধ। পেছতে পেছতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। তাদের ভুলের মাশুল উত্তরসূরীদের দিতে হবে কেন।