ছবি: সংগৃহীত।
একুশে মানেই সেই শক্ত মেরুদণ্ড, যা নোয়ানো যায় না। একুশে মানে শুধু হাত দিয়ে নয়, সমস্ত শরীর দিয়ে, অন্তর দিয়ে নিজের শেকড়, নিজের মায়ের মুখের অক্ষরগুলো স্পর্শ করা। এই ঢাকা শহরেই হয়েছিল সেই ভাষার লড়াই, ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে, রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছিল বর্ণমালার জন্য বিশ্বের সব মানুষকে ছুঁয়ে দেওয়ার এক অনন্য ইস্তেহার। আর সেই কারণেই ভাষা শহিদদের স্মরণে তৈরি করা শহিদ মিনারের আর এক নাম— সাহস। সেই সাহস, যেই সাহসে বাহান্নোকে স্পর্শ করে রচনা করা যায় একাত্তর। সেই সাহস, যা পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেয় ৩০ লাখ মানুষের রক্তের স্রোতে।
’৪৭-এর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পরে পরেই এই ভূমির মানুষ পরিষ্কার বুঝেছিলেন, এই পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র কাঠামোটি কখনওই এই ভূমিখণ্ডের অধিবাসীদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। সে কারণেই ভিন্ন সংস্কৃতির পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রথম ষড়যন্ত্র, বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রের ভাষা বানানোর হীন ষড়যন্ত্র বুঝে নিতে সময় লাগেনি আমাদের পূর্ব প্রজন্মের। তাঁরা সে দিন হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি বর্ণমালার যোগ্য পাহারাদার। জান কবুল করে রুখে দিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের সেই নষ্ট চেষ্টা। সে দিনের বাস্তবতাটি আজকের প্রজন্মের ভাবা দরকার। সদ্য ‘স্বাধীন’ পাকিস্তানের মূল খুঁটিই ছিল ধর্ম। মুসলিম লিগ বিভাজনের কুমন্ত্রই সাধারণের কানে দিয়েছিল, যে মন্ত্রে হাজার বছরের ভরসা রাখার বাঙালি তাদের বাঙালি পরিচয় ভুলে ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। হয়েছিল বলেই পাকিস্তানি শাসকেরা সেই সুযোগের ব্যবহার করে আক্রমণ করতে চেয়েছিলো শেকড়ে। তাদের ‘খায়েশ’ ছিল, বাঙালির মুখের হাজার বছরের ভাষাটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার। আর সেই ‘খায়েশ’ থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার বদলে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাটিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। আর এই ক্ষেত্রে আর একটি কথা মনে রাখা দরকার। সেই সময়ের পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে পুরো পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু সেই অধিকাংশের ভাষাকে সে দিন চাপা দিয়ে লঘিষ্ঠের ভাষাকে সামনে আনা হয়েছিল, তা ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করতে।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের যন্ত্রণা
সময় ধাবমান। ’৫২ থেকে ২০১৭ অনেক বছর। এর মাঝে অনেক বদলে গেছে পৃথিবী। ভাষার দাবিতে যে লড়াই শুরু তার পরিণত একটি রূপ স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের বয়সও ৪৫ পেরিয়েছে। অর্থনীতি রাজনীতি সবখানেই বদল। বদল জীবনযাপনেরও। অ্যান্ড্রয়েড ফোন আর ইন্টারনেট যেমন এক করে দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে, তেমনই এখন সময়ের অসুখগুলো হামলা করছে।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪। আতাউর রহমান খান ও অলি আহমেদের নেতৃত্বে ঢাকার পথে শহিদ স্মরণে মিছিল।
রাজনীতি থেকে যেমন সম্পূর্ণ সরে যায়নি পাকিস্তানি ভাবাদর্শ, তেমনই সরে যায়নি দিনযাপনের প্রাত্যহিকতা থেকেও। যে কারণেই একুশের শোকের সঙ্গে সঙ্গে লড়াইটাও জরুরি হয়ে উঠছে আবারও। সাম্প্রতিক সময়ে বাঙালি সংস্কৃতির ওপরে হামলার রূপ পাল্টেছে। গত কয়েক বছর আগে ব্লগার হত্যা দিয়ে সে অন্ধকার শক্তির প্রকাশ আমরা দেখেছি, তার ভয়াবহ রূপ হলি আর্টিজান বেকারি। আর এই হামলাগুলোর বিরুদ্ধে যে লড়াই, সেখানেই দরকার একুশে-কে। আমরা সেই সময়ে পেয়েছিও একুশের সাহস।
একুশে মানে মাথা নত না করা, সে কারণেই আমরা যখনই অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছি, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের নিশানা। ভাষার এই শক্তি ক্রমেই যেমন বেড়েছে, তেমনই যারা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ তাদের নিশানাও বেড়েছে। বেড়েছে বলেই ভাষার হাত ধরে থাকা মুক্তচিন্তার উপরে হামলা, বাঙালি সংস্কৃতির উপরে হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে। কারণ প্রতিপক্ষ জানে, বাঙালির শেকড়ের নাম তার ভাষা আর ভাষার লড়াই, সেখানে থেকেই দৃঢ় হয়ে ওঠে এখানের সংস্কৃতির উদারতা। সে কারণেই আমরা দেখেছি পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সময়েই গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহিদ মিনার। কিন্তু শহিদ মিনার শুধু আমাদের কাছে ইঁট সিমেন্টের অবয়ব নয়। আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে এক একটি শহিদ মিনার। সেই মিনার কখনও ভেঙে ফেলা যায় না।! তার বিনাশ নেই আছে বিকাশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একুশের লড়াই দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। আজ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের শহিদেরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার প্রহরী— বাংলাদেশ পেয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি। সে কারণেই দেশটির দায়িত্ব বেড়েছে, ভাষার পাহারাদার হয়ে শুধু নয়, ভাষার লড়াইকে কেন্দ্রে ধারণ করেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে সব অন্ধকার, জিততে হবে সবগুলো লড়াইয়ে। আর সেই লড়াইয়ে একুশ আছে, থাকবে আমাদের শেকড় আর সাহস হয়েই।