বকুলবাগানের প্রতিমা
কলকাতার নামকরা থিমপুজোগুলির অন্যতম হল বকুলবাগান সর্বজনীনের পুজো। এ বছরে তাদের বিষয় ভাবনায় উঠে এসেছে ‘মাশান’ চিত্রকলা। ‘ভয়ে ভক্তি’ বলে একটা কথা খুব প্রচলিত। সমাজের সর্বস্তরে এই প্রবাদটি যেন বেদবাক্য। কেন এল এই প্রবাদ? অনেক কারণই খুঁজে পাওয়া যাবে অনুসন্ধান করলে। কিন্তু এই পুজোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায়? সে উত্তর মিলবে এই থিমের গভীরে গেলেই। এ বছর এই পুজোয় থিমশিল্পী হিসেবে রয়েছেন অদিতি। সহযোগিতায় সঞ্জীব ঘোষ। আবহসঙ্গীতে অর্পণ ঠাকুর চক্রবর্তী এবং প্রতিমায় শিল্পী হ্যালি গোস্বামী।
‘মাশান’ শব্দটি এসেছে শ্মশান থেকে। ‘মাশান’ আসলে এক জন দেবতা, যাঁর পুজো শ্মশানেই হতো। মনে করা হয়, চিনে এই মাশান শিল্পের উৎপত্তি। সিল্করুট বন্ধ হয়ে সে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের হাত ধরে এই চিত্রকলা নতুন ভাবে চর্চিত হতে শুরু করে। রেশমের থাঙ্কর কাপড়ের বদলে উত্তরবঙ্গের জলাভূমিতে উৎপন্ন সহজলভ্য শোলা হয়ে ওঠে এই শিল্পের মাধ্যম। রাজবংশী মালাকার জাতি এই চিত্রকলার একমাত্র ধারক বাহক হয়ে ওঠে।
প্যান্ডেলের ভিতরের দৃশ্য
বেশির ভাগ লোকশিল্পের আধার সমসাময়িক মানুষের জীবনচর্চা। আর এখানেই আসে ‘ভয়ে ভক্তি’-প্রবাদের উপযুক্ত ব্যবহার। শ্মশান সব সময়েই মানুষকে একটা ভয়ের আবহ দেয়। সেই ভয় থেকে বাঁচতেই মানুষ সেই শক্তির আরাধনায় ব্রতী হয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। আরও একটা কারণ হল সমস্ত নেতিবাচক শক্তিকে দূর করে নিজেদের অন্তরের শুভ ও ইতিবাচক বোধ জাগ্রত করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের হাতে কিছু থাকে না। তখন কিন্তু ভরসা জোগায় পূজার্চনা। সেই ভরসা থেকেই মাশান দেবতার পুজো শুরু হয়েছিল। যার সূত্রে মাশান চিত্রকলার সৃষ্টি।
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর প্রচলন এ রকমই নেতিবাচক শক্তিকে দূর করার উদ্দেশ্যে। অসুররূপী সামাজিক ব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের নৃশংসতা– এ সব ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ যেন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। চার দিকে ঘটে চলা অসন্তোষ, অপরাধ, মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা হয়ে উঠেছে বকুলবাগান সর্বজনীনে দুর্গার আবাহনের মূল উদ্দেশ্য। যার মাধ্যম হয়ে উঠেছে প্রাচীন লোকশিল্প, মাশান চিত্রকলা।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।