প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগের কথা। ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ে সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহের স্বপ্নে দেখা দেন দেবী দুর্গা। দেবীর নির্দেশ মতো রানির হাতের সোনার কাঁকন দিয়ে রাজা নির্মাণ করান এক দেবীমূর্তি। নাম হয় ‘কনক দুর্গা’।
দেবীকে ঘিরে হাজারো কাহিনি ও কিংবদন্তী ছড়িয়ে গোটা ঝাড়গ্রামে। যেমন শোনা যায়, অতীতে দেবীর এক পুরোহিত নিত্যপূজা সেরে বাড়ি ফেরার পথে একটি কালো রঙের খরিশ সাপ তাঁকে দংশন করে। পুরোহিত সে যাত্রা বেঁচে যান। দেবী তাঁকে স্বপ্নে আশ্বাস দিয়ে বলেন, মন্দির সংলগ্ন এলাকায় আর কালো খরিশ সাপ থাকবে না। সেই থেকেই নাকি ওই এলাকায় আর কালো খরিশ সাপ দেখা যায় না।
ওড়িশা থেকে আসা ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীর পরিবার বংশ পরম্পরায় ঝাড়গ্রাম রাজ পরিবারের কুল পুরোহিত। বর্তমান পুরোহিত জানান, কনক দুর্গার মন্দিরে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। তাতে বলির প্রথাও রয়েছে। এক সময়ে নাকি মহানবমীতে নরবলি হত। সে রেওয়াজ বহু কাল হল উঠে গিয়েছে। এই প্রথার নেপথ্যে রয়েছে এক আশ্চর্য কাহিনি। শোনা যায়, দেবীই নাকি রাজাকে আদেশ দিয়েছিলেন, নরবলি দিয়ে সেই রক্তে তাঁকে স্নান করাতে হবে। রাজা পড়েন মহা চিন্তায়-- কাকে বলি দেওয়া হবে! রাজাকে চিন্তামুক্ত করেন দেবীই। নবমীর দিনে নাকি এক যুবক হাজির হয়ে স্বেচ্ছায় হাড়িকাঠে মাথা দেয়। দেবী তুষ্ট হন। সেই থেকেই নরবলির প্রথা শুরু। পরে যা পাল্টে গিয়েছে মহিষ বলিতে।
কণক দুর্গা মন্দিরে নরবলি বন্ধের কাহিনিও ততটাই অদ্ভুত। শোনা যায়, অতীতে সে সময়ে প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় বলি দেওয়ার জন্য এক জন নিখুঁত মানুষের প্রয়োজন পড়ত। আর সেই মানুষকে খোঁজার গুরুদায়িত্ব ছিল চার রাজকর্মচারীর উপরে। এক বার বলির জন্য রাজকর্মচারীরা এক বালককে বন্দি করে একটি অন্ধকার কুঠুরিতে রাখেন। যথারীতি মহানবমীর দিনে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাড়িকাঠের সামনে। বলির সময়ে সেই বালক হঠাৎ জোর গলায় দুর্গাস্তব আওড়াতে শুরু করে। ঘাবড়ে যান উপস্থিত সকলেই। ছুটে আসেন রানি গোবিন্দমণি। তিনিই দেবীর উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রার্থনা করে বন্ধ করেন নরবলি। মুক্তি দেন দুর্গাভক্ত সেই বালককে। রাজাও রানির কাজে সমর্থন দিলেন। সেই থেকেই নাকি নবমীর পুজোয় নরবলি বন্ধ হয়ে শুরু হয় মহিষ বলি। সে প্রথা আজও চলছে, যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন কনক দুর্গা মন্দির চত্বরে। এমনকি গাছের উপরেও নাকি তিল ধারণের ঠাঁই মেলে না!
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।