Bonedi Bari Durga Puja

বনেদি বাড়ির এই পুজোয় একসঙ্গে আড্ডায় মেতেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-বঙ্কিমচন্দ্র!

নিজস্ব আচার-রীতিনীতি মেনে জাঁকজমকের পুজো- বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর ট্রেডমার্ক। উত্তর কলকাতার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটে এমনই ছবি অধরলাল সেনের বাড়ির দেড়শো বছর পেরনো পারিবারিক দুর্গাপুজো।

Advertisement

আনন্দ উৎসব ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৩৫
Share:

বিভিন্ন বনেদি বাড়ির সাবেক পুজো ছাড়া কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস অসম্পূর্ণ। একশো, দেড়শো, দুশো, কোথাও কোথাও আড়াইশো, এমনকী তিনশো বছরের পুরনো এই সব পুজো যেন নিজেরাই বহমান ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় যা চলে আসছে আজও, প্রতি বছর।

Advertisement

থামে ঘেরা অট্টালিকায় বিশাল ঠাকুর দালান। তাতে একচালার দুর্গা, পরিবারের নিজস্ব আচার-রীতিনীতি মেনে জাঁকজমকের পুজো- বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর ট্রেডমার্ক। উত্তর কলকাতার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটে এমনই ছবি অধরলাল সেনের বাড়ির দেড়শো বছর পেরনো পারিবারিক দুর্গাপুজো।

সে ভাবে প্রচারের আলোয় আসেনি সেনবাড়ির পুজো। কিন্তু স্রেফ একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই এই পুজোর তাৎপর্য বোধহয় কলকাতার অন্য সব বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর চেয়ে আলাদা। অধরলাল সেনের বাড়ির পুজোয় এক বার একসঙ্গে আড্ডায় মেতেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! এ-ও তো এক চিরস্মরণীয় ইতিহাস।

Advertisement

মাত্র ৩০ বছরের ছোট্ট জীবন অধরলালের। তার মধ্যেই তিনি ছিলেন অসামান্য ছাত্র, ইংরেজি সাহিত্যে পণ্ডিত, কবি, আবার ওই বয়েসেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট! তাঁর লেখা দু’টি কবিতার বই সে যুগে যথেষ্ট প্রশংসিত ছিল। অধরলালের উপরে এক দিকে ছিল ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব। তেমনই শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের মাত্র তিন বছর আগে আলাপের পরে তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শোনা যায়, ভক্তের বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বাড়িতে কয়েক বার এসেওছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তার মধ্যেই এক বার এসেছিলেন পারিবারিক দুর্গাপুজোয়। ঘটনাচক্রে সে দিনই প্রায় একই সময়ে ওই বনেদি বাড়ির পুজোয় আসেন আরও দুই মনীষী। স্বামী বিবেকানন্দ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জনে একসঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কথাবার্তা বলে কাটিয়েওছিলেন তিন জনে।

স্বামী বিবেকানন্দের গানের গলা ছিল অসামান্য। পারিবারিক ইতিহাস বলে, সে দিন সেনবাড়ির ঠাকুর দালানে বসে নয় নয় করে ২৭টি ভক্তিমূলক গান গেয়েছিলেন তিনি! আর প্রিয় নরেনের গান শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

অধরলালের নামেই বেনিয়াটোলা স্ট্রিটে সেন পরিবারের প্রাসাদোপম বাড়ির নাম 'অধরালয়'। দেড়শো বছর পার করা দুর্গাপুজো আজও হয় সেখানেই। অন্যান্য বনেদিবাড়ির মতো 'অধরালয়'-এর পুজোরও নিজস্ব পারিবারিক কিছু আচার রয়েছে। সেই রীতিনীতি পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে আজও পুজো হয়।

সেনবাড়ির শারদীয়ায় দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো পুজো হয় রথযাত্রার দিনে। কুমোরটুলির এক নির্দিষ্ট মৃৎশিল্পীর পরিবারই বংশ পরম্পরায় এই বাড়ির প্রতিমা বানিয়ে আসছে এখনও। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত একচালার ঠাকুর গড়ার গোটা কাজটা 'অধরালয়'-এর ঠাকুর দালানেই হত। এখন সময়াভাবে শিল্পী কুমোরটুলিতে তাঁর স্টুডিওয় ঠাকুর গড়ে শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তির দিনে সেনবাড়ির ঠাকুর দালানে প্রতিষ্ঠা করেন মা-কে। তার পরে শাড়ি-গয়না পরিয়ে প্রতিমাকে সালঙ্কারা করে তোলার দায়িত্ব নেন বাড়ির বৌ-মেয়েরা।

মহালয়ার পরদিন, প্রতিপদের ভোরে ঘট প্রতিষ্ঠা হয়। সে দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় সকাল-সন্ধে দু'বেলা পুজো। মহাষষ্ঠীতে আরও একটি ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। দশমী অবধি দুটো ঘটেই পুজো চলে। 'অধরালয়'-এর পুজোয় মা দুর্গাকে শুকনো অন্নভোগ নিবেদন করা রীতি। নৈবেদ্যে দেওয়া হয় চাল, রান্না করা ভোগ নয়। বদলে মায়ের ভোগে থাকে লুচি, নানা রকম ভাজা ও বিভিন্ন মিষ্টি। বাইরে থেকে রাঁধুনি আসে, ভিয়েন বসে। কিন্তু ঠাকুরের ভোগ সবার জন্য নয়। পরিবারের সদস্যদের ও অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য আলাদা খাবারের আয়োজন করা হয়। তবে সবটাই নিরামিষ। বিজয়া দশমীতে আমিষ খাওয়াদাওয়া। সে দিন মাছ-মাংস-ডিম তিনটেই থাকে পাতে। পরিবারের মহিলারা দশমীতে দুর্গাবরণের পরে উপোস ভেঙে খাওয়াদাওয়া করেন।

সেনবাড়ির দুর্গাকে বিসর্জন দেন শুধু পুরুষরা। প্রতিমা কাঁধে করে বাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তবে কালের নিয়মে লোকবল কমেছে এই পরিবারেও। কর্মসূত্রে এ বাড়ির অনেকে এখন ভিন রাজ্য বা বিদেশেরও বাসিন্দা। প্রতিমা কাঁধে চাপিয়ে বিসর্জনে যেতে তাই বাইরে থেকে লোক ভাড়া করা হয় ইদানীং।

কিন্তু প্রতি বছর ঢাকে কাঠি পড়লেই শিকড়ের টানে বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বাড়িতে অন্তত কয়েক দিনের জন্য ফেরার চেষ্টা করেন পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য। আসেনও। মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী, এই বনেদিবাড়ির পুজো জমে ওঠে ছেলে-বুড়ো-বাচ্চার আনন্দ কলরবে!

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement