এত দিন থিমের আলগা ছোঁয়ায় অর্ধনারীশ্বর সত্তার উদ্যাপন করেছে বাঙালির দুর্গাপুজো। কিংবা কোনও কর্পোরেট ব্যবস্থাপনার সিঁদুরখেলায় ‘সবারে করি আহ্বান’-এর মর্ম বোঝাতে ডেকে এনেছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত রূপান্তরিত মহিলা বা ট্রান্সনারীকে। কিন্তু সত্যিই কি সবার হয়ে উঠতে পেরেছে দুর্গাপুজো?
গত বছর সোনাগাছির যৌনপল্লির পুজো-প্রচারে শিন্টু বাগুই নামে রূপান্তরকামী এক নারীই দেবীরূপে সেই পুজোর মুখ হয়ে ওঠেন। আবার রূপান্তরকামী নারী তথা
সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিংহ তাঁর বাড়িতে তৃতীয় লিঙ্গ বা যৌনসংখ্যালঘু সমাজের সুহৃদদের নিয়ে নিজেদের মতো পুজোর আয়োজন করেন। গত বছর রূপান্তরকামী পুরুষ কবিরাগ পোদ্দার তাতে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর নিজস্ব ঢঙে। কিন্তু পুজোর মূল স্রোতে থিমের টক্কর, ধ্রুপদী আচার-অনুষ্ঠান থেকে কার্যত ব্রাত্যই থেকে গিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন। এ বার শহরের একটি পুরনো ঐতিহ্যশালী পুজো আদি বালিগঞ্জ সর্বজনীন, সেই কুসংস্কারের দেওয়াল ভাঙতে চলেছে।
পাড়ার পুজোর মুরুব্বি, তাঁর কানুজেঠু ওরফে মহেশ ভট্টাচার্য কিংবা নিজের বাবা দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে বিষয়টা বোঝাতে সময় লেগেছিল সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজ থেকে সমাজতত্ত্বে সদ্য স্নাতক যুবা ধীরাজ মুখোপাধ্যায়ের। পুজোর ৭০ বছরে কলকাতা বা দেশে সমকামী-রূপান্তরকামীদের ‘গৌরব-যাত্রা’র গল্পটা মেলে ধরলে কেমন হয়, সেটা বোঝাতেই আসরে নামেন একেলে তরুণ। ‘‘আমি তো আমার বন্ধু, বা পাতানো দাদা-দিদিদের মধ্যেও সমকামী প্রবণতা দেখেছি। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীদের বিষয়টাও জানি! তাঁদের জন্য পুজোয় একটা স্বাচ্ছন্দ্যের পরিসর গড়ে তোলার কাজটা কেন করতে পারব না!’’ ঠিক এক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টে ৩৭৭ ধারার গা থেকে অপরাধের তকমা মুছে দেওয়ার রায়ই ধীরাজের কাজের ভিতটা গড়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: পুজোয় এ বার থিমের প্রবেশ সোনাগাছিতে
আজকের কলকাতায় রেস্তরাঁয়, হাসপাতালে রূপান্তরকামী-সমকামীদের জন্য সহৃদয় পরিসর গড়ে তোলার আদলেই বালিগঞ্জের পুরনো পুজোয় মিশছে সবাইকে কাছে টানার রামধনু রং। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা দিদির সঙ্গে আলোচনার সূত্রেই সলতে পাকিয়েছে পুজো-ভাবনা। সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় পুজোমণ্ডপের পাশেই ছবি-ট্যাবলোয় এ দেশে ৩৭৭ হটানোর আন্দোলনের গল্প বলা হচ্ছে। মেয়ে-পুরুষের ছক-বাঁধা সম্পর্কের বাইরের যৌনতা যে বহু যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির শিকড়ে মিশে সে কথাও শোনাবে পুজোমণ্ডপ। সমকামী ও রূপান্তরকামীদের আন্দোলনের সূত্রে ভাদু-আলকাপ থেকে ‘ফিমেল অভিনেত্রী’ চপলরানিদের ঐতিহ্য বা কলকাতার ‘গে ব্যালে’র কথা তাতে তুলে ধরা হবে। ফেসবুকের হ্যাশট্যাগে এ পুজোর পরিচয়ই গর্বের পুজো বা পুজোউইথপ্রাইড।
বাপ্পাদিত্য বলছিলেন, ‘‘সমকামী এবং রূপান্তরকামী যুগলদেরও ডাকব এ পুজো দেখতে! রামধনু রঙা সেলফি-জ়োনও ভাবনায় আছে।’’ মহালয়াতেই পুজোর উদ্বোধন। রূপান্তরকামী নারী অচিন্ত্য সে দিন আলপনার রেখা-রঙে মণ্ডপপ্রাঙ্গণ ভরিয়ে তুলবেন। আলপনার মোটিফেও মেয়ে-পুরুষের ছকে বাঁধা অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জের
ইচ্ছা অচিন্ত্যর।
আরও পড়ুন: পাঁচশো বছরে অমলিন মৌতড়ের ‘বুড়ি দুর্গা’
এই পুজো যাঁরা শুরু করেছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের পুত্রই এখন পুজোর কর্ণধার। ৭২ বছরের প্রবীণ মহেশবাবুর কথায়, ‘‘উৎসবে আনন্দে মানুষে মানুষে ভেদ রাখতে চাই না। আমাদের পুজো সাবেক রীতির পুজো। কিন্তু তা যে সবার পুজো, এটাও বোঝানোর সময় এসেছে।’’