Mythological Stories of Kali Puja

রঘু ডাকাত কালীর মন্দিরে বলি দিতে চেয়েছিলেন সাধক রামপ্রসাদকে! সে মন্দির আজও আছে

এক রাত্তিরে জঙ্গলের মধ্যে একা সাধক রামপ্রসাদ সেনকে পেয়ে মাতৃমূর্তির সামনে বলি দিতে চেয়েছিল রঘু ডাকাতের দল! তার পর কী হয়েছিল?

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:১৯
Share:

দ্রুত হেঁটে চলেছেন সাধক রামপ্রসাদ। তাঁর বড় তাড়া। বিশেষ এক খবর এসে পৌঁছেছে তাঁর কাছে। পরম সুহৃদ মৃত্যুশয্যায়। তিনি তাঁকে দর্শন করতে চান। তাই জঙ্গলাকীর্ণ পথ ধরে সাধক হেঁটে চলেছেন ত্রিবেণী ঘাটের দিকে।

Advertisement

ডাকাত ও ব্যাঘ্রের ভয় প্রবল। নিকষ কালো রাতের ভয়ঙ্করতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। প্রিয় জনের প্রতি গভীর উদ্বেগ তাঁকে উদভ্রান্তের মতো টেনে নিয়ে চলেছে। দু’পাশ থেকে আচমকা ‘হারে রে রে’ ধ্বনিতে তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়া কয়েকজন ডাকাত!

এ দিকে রামপ্রসাদের কাছে আছেই বা কী, যা ডাকাতরা হাতাবে?

Advertisement

অতএব তারা ঠিক করল বলি দেবে ঠাকুরকে। মিনতি করলেন রামপ্রসাদ ঠাকুর, তিনি দরিদ্র ব্রাহ্মণ এবং মাতৃসেবক। এমনিতেই তিনি মায়ের কাছে বলি প্রদত্ত। তবে এখন একজন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর দর্শনপ্রার্থী। তাই তারা যেন তাঁকে ছেড়ে দেয়। ফেরার সময় তারা তাঁকে নয় মায়ের কাছে উৎসর্গ করুক। কিন্তু ডাকাতরা নাছোড়।

রামপ্রসাদ ঠাকুরকে টেনে তাঁরা নিয়ে চললেন।

গলা নামিয়ে দিলেন হাঁড়ি কাঠে। ঠাকুরের দু’চোখ বেয়ে তখন অশ্রুধারা। না মৃত্যুভয়ে নয়, ব্রহ্মময়ীর কাছে তিনি মনপ্রাণ সমর্পণ করেছেন।

আজ তো কেবল দেহটুকু যাবে। তাতে কী’ই বা! কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সঙ্গে দেখা করা হল না এই দুঃখটুকু নিয়ে মায়ের জন্য বলি গিয়েও তাঁর স্বস্তি নেই।

কী আর করা! হাঁড়ি কাঠে গলা দিয়ে মায়ের গান ধরলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন।

আঃ, সে কী অপূর্ব মাতৃ আকুতি! বাতাস থমকে গেল। ডাকাত সর্দার প্রত্যক্ষ করলেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য— তাঁর সামনে বেদিতে দেবী কালী হাঁড়ি কাঠে মাথা দিয়েছেন! সাধক ঠাকুর আর মা লীন হয়ে গিয়েছেন!

খড়্গ ফেলে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন ডাকাত সর্দার।

এ কী অপরূপ দৃশ্য দেখালেন মা! সেদিন হতে, সেই কাল হতে নরবলি বন্ধ করলেন সেই ডাকাত। তিনি ডাকাত সর্দার রঘু! রঘু ডাকাত!

সাধক রামপ্রসাদের সেই পরম দর্শনে রঘু ডাকাত ও বিধু ডাকাত মায়ের সেবা করলেন বটে, কিন্তু নরবলি নয়, কেবল ল্যাটা মাছের ভোগটি দিয়ে শুরু হল মায়ের অর্চনা!

আর ওই রামপ্রসাদী শ্যামাসমর্পণী সঙ্গীতটি খ্যাত হয় আপাতকালীন চতুষ্টয় রূপে। ওই শ্যামাসঙ্গীতে আপাতকালে আকুল হয়ে ডাকলে তিনি উদ্ধার করেন। গানটি হল— ‘তিলেক দাঁড়াও ওরে শমন/ বদন ভরে মাকে ডাকি’।

সেই কাল হতে আজ অবধি প্রায় পাঁচশোর বেশি বছর ধরে সেই বিখ্যাত রঘু ডাকাতের কালী মা আজও পূজা পেয়ে আসছেন। ল্যাটা মাছের মহাভোগটি খাওয়ার জন্য শনি, মঙ্গলবার ও অমাবস্যার দিন বহুদূরান্ত হতে মানুষের ঢল নামে।

সময় বলে বাগহাটের রঘুভূষণ ও বিধুভূষণ দুই ঘোষ ভাই কোনও এক সময় জমিদারদের দ্বারা ভয়ানক অত্যাচারিত হয়েছিলেন। তার পর থেকেই তাঁরা জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। জমিদারদের থেকে লুণ্ঠন করা ধন বিলিয়ে দিতেন দরিদ্র সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাই তাঁদেরকে কেউ ধরতে পারত না।

ডাকাতি কালে ধনী-গরিব নির্বিশেষে নারীকে অসম্মান করতেন না তাঁরা। কিন্তু ধনীর গৃহ থেকে একটি করে পুরুষকে নিয়ে আসতেন। তাকে মায়ের কাছে বলি দিয়ে, ল্যাটা মাছের ভোগ খেয়ে ডাকাতিতে বের হতেন। এই পর্বটি হচ্ছে রামপ্রসাদ সেনের ঘটনার আগে।

যে দিনের কথা আমরা আলোচনা করেছি, সে দিন সাধক রামপ্রসাদকেই তাঁরা বলে কোনও ধনী ভ্রম করেছিলেন। আসলে, মাতৃ সাধনার জ্যোতিতে তাঁর দেহের ঔজ্জ্বল্য ছিল অভিজাতপ্রম। রামপ্রসাদ ঠাকুরের হাত দিয়ে মা সে দিন রঘুকে চৈতন্য দিলেন। সেই মর্মস্থল খ্যাত হল ত্রিবেণীর ডাকাতে কালী নামে।

চাইলে, আপনিও দর্শন করে আসতে পারেন সেই মাতৃমূর্তিকে। মহাপ্রসাদের ভোগ খেয়ে তৃপ্ত করতে পারেন নিজেকে। হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেবপুরে গঙ্গার ঘাটের কাছে আছে সেই পুরাতন মন্দির। মায়ের মন্দিরের কাছেই বটবৃক্ষ তলে অবস্থান করছেন মায়ের ভৈরব বাবা বিশ্বেশ্বর!

তথ্যসূত্র: মুক্তির আশে শক্তির পাশে ( সত্যরঞ্জন দাস), জনশ্রুতি

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement