প্রতীকী চিত্র
ছোটবেলায় শুনেছিলাম, একলা হয়ে যাওয়া নাকি ভাল নয়। জনসমষ্টির মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়ার মধ্যে, নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার মধ্যেই যত গৌরব। সে সব ভুল হয়ে গিয়েছে। একের পর এক প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার পরে জেনেছি, লড়াই কতটা ক্ষুরধার। নির্মম। আমার মেয়েটাকেও যা ছেড়ে কথা বলে না। সমাজ এই মানুষদের সহজে আর গ্রহণ করতে পারে না।
ছকে চলা জীবনে, সমাজের যক্ষপুরীতে শুনি ‘এটা করতে নেই। ওটা পাপ। এটা অশুচি।’ চলছে তো চলছেই। যে দুর্গাপুজো এক সময়ে ছিল রঙিন, মুক্তির খোলা আকাশ, সে যে এমন নিয়মের মায়াজালে মলিন- এ সময় তা বেশি করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। পরিবার, বন্ধু, সম্পর্ক পুজোয় ঘিরে থাকত আমায়। সেই পুজোকে বহু জনতার আনন্দ হিসেবে চিনেছি। আচারকে বড় করে দেখতে শিখিনি কোনও দিন। সেখানে হঠাৎ নিয়ম শাসন হয়ে পথ আটকাল। আজ যদি ইচ্ছে করে দুর্গাকে বরণ করব, এমন তো নয় যে কেউ আমার পথ আটকাবে না। কেউ বলবে না অশুচি? এ সব কিছুর জন্য সাহসও নাকি যথেষ্ট নয়। পুজো এলে তাই আমার মতো মেয়েদের খানিক শঙ্কা হয় বৈকি। সব কিছুই সধবার আচার। মানে যে মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করল না, সে-ও পুজোর কিছু নির্দিষ্ট কাজে ব্রাত্য। বিবাহিত বর না জোটাতে পারলে ধম্মকম্মেও নিষেধ! সিঁদুর পরিয়ে দিলেই কি শুধু সিঁদুর খেলা যায়? প্রশ্নটা প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়। এক মেয়েকে ধর্ষণ করা হলে তার নগ্নতার মধ্যে সমাজ লজ্জা খোঁজে। পাশাপাশি পুরুষটির শরীর নিয়ে কোনও কথাই ওঠে না।
এই লেখা লিখতে গিয়ে ইউনিসেফের রিপোর্ট দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি বিশ্বে ৩৭ কোটি মেয়ে যৌন হেনস্থার শিকার। এর শেষ তো নেই-ই, বরং এই বর্বরতার প্রাথমিক শেষের আশাটুকুও নিভে আসছে। পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে পুরুষের নগ্নতা চাপা পড়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে তার সম্মানহানির প্রশ্ন তো ওঠেই না। বরং সে কত ক্ষমতাশালী, সেই দিকটাই বড় হয়ে আসে। সোনার আংটি যখন ব্যাঁকা, তার আবার নগ্নতা কী! শরীর কী!
এমন অজস্র বিষয় আমাদের রক্তে মিশে আছে, যার দায় মেয়েদেরই নিতে হয়। এমন দেখেছি যে মেয়ে একা, একাই সে সন্তানকে বড় করেছে, তার মৃত্যুর পরে তার জন্য শোক করারও কেউ থাকে না। শোক অবশ্য নিষ্প্রয়োজন।
তবে এত গভীর করে ভাবার সময় কোথায়? এ সব উড়িয়ে দিলেই হয়! হয় কি? যা বিবাহিত মহিলারা পারে, তা কখনওই 'বিধবা ' মহিলারা পুজো-পার্বণ বা বিয়ে, কিংবা অন্য কোনও শুভ অনুষ্ঠানে ইচ্ছে থাকলেও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সময় বদলেছে। এখন তো কত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই স্বামীর মৃত্যুর পরে মহিলারা লাল শাড়ি পরছে। মাংস খাচ্ছে। বাহ! এই তো অনেক হচ্ছে। তাই বলে দেবী বরণ! হয় নাকি?
মেয়েদের মধ্যেও প্রচুর ভাগাভাগি। কোনও জমায়েতে দেখেছি, হয়তো যে কোনও কারণেই হোক, কোনও মেয়ের দু' বার বিয়ে হয়েছে। ব্যস, তাকে নিয়ে নিয়মিত বরের হাতে মার খাওয়া মেয়েদের মশকরার হাট। সেখানে অধ্যাপিকা, কর্পোরেটের উচ্চপদস্থ মহিলারাই সেই মেয়েকে নীচে নামিয়ে আনেন, ওয়াইনের শহুরে আড্ডায়। ভাষায় নগ্নতা প্রকট হতে থাকে। মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন অংশ উল্লেখ করে আলোচনা হয়, শরীরের কোন অংশ দিয়ে সে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে বশ করেছে। ' নষ্ট' মেয়েরা যা করে থাকে। পুরুষ বেচারি এতই নিরীহ, সে বশ হয়েই যায়। এই বিশ্বাস চিরকালীন। পিতৃতন্ত্রের ভয়াবহতা ছাড়া এ আর কিছুই নয়। মেয়েদের নানাবিধ ভাগে তাই বিয়ের সংখ্যা গুণে বিচার হয়। বিচার হয় কোন মেয়ে স্বামীবিচ্ছিন্ন হয়ে একা থাকে, কোন মেয়ে বিয়ে না করে সহবাস করে, কে বাচ্চা নিতে চায় না, কোন মেয়ে মা হতে পারল না। আরও কত যে বিভাজন! আর বিভাজন ঘিরে ঘিরেই তাদের ঠুনকো নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখার আয়োজন। ব্যতিক্রম আছে। সংখ্যায় বড্ড কম। বাড়ির ভিতর, পরিবারের রুদ্ধ দেওয়ালে যে সংলাপ বিনিময় হয়, সেখানে আজও ফর্সা, সুন্দরী, সংসারী, রান্না ভাল করা, দারুণ বাচ্চা মানুষ করা মেয়েদের কদর। তার সঙ্গে ভাল রোজগারের মেয়ে, লক্ষ্মী লাভের মতো। তবে নারায়ণ সকলের আগে। মন্দির আর পরিবার এখানে এক হয়ে আছে।
স্বামীহীন মহিলাদের দশভুজা হয়ে ওঠার দায় বোধ করি নেই। এই জায়গাতেই বিধবা হওয়ার একমাত্র সুখ। যিনি দেবী দুর্গা তিনি সধবা। পুরুষ দেবতাদের দেওয়া অস্ত্রতেই কিন্তু তিনি অসুর বধ করেন। নচেৎ? কিন্তু তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সব নিয়ে তিনি ঘোর সংসারী। বাপের বাড়ি আসেন সব্বাইকে নিয়ে। তিনি অসুর মারেন (এখন যেমন প্লেন চালায় মেয়েরা, কেউ পড়ায়, কেউ কুস্তি লড়ে) আবার সন্তানদের সব দায়িত্ব তাঁর, ( মাকেই কিন্তু ছেলে-মেয়েদের দেখতে হয়)। তা হলে মেয়েদের দুগ্গার মতো সব সামলাতে হবে। হিসাব মিলিয়ে দেওয়া গেল। স্বামীহীন মেয়েদের কথা আলাদা। তাদের আবার সংসার হয় নাকি? ফলে তাদের বোধ করি আর দশভুজা হওয়ার দায় নেই।
তবে আমি জানি, আমার মতো বহু মেয়েদের দায় আছে নিজের পৃথিবী তৈরি করার। নিজের মতো করে আসলে জীবনটাকে দেখে নিতে হবে, চেখে নিতে হবে। বুঝেছি যে মেয়ে একলা, সে অনেক নিশ্চিন্ত। তার চার দিকে নকল কলরব নেই। সে অনেক মুখোশ পরা মুখকে বাদ দিয়ে বাঁচতে শিখেছে। তার জোর আছে। রক্তচাবির গোছায় স্মৃতি-বিস্মৃতির আড়ালে সে জীবন দেখছে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।