আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজো
Durga Puja 2019 Ananda utsav 2019 Durga Puja Celebration

আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজোয় কুমারীকেও হাতে পরতে হয় শাঁখা

তখন অবশ্য অপভ্রংশ হয়ে জায়গার নাম ‘আন্দুল’ হয়নি। নাম ছিল ‘আনন্দধূলি’।

Advertisement

অর্পিতা রায়চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৬:০৪
Share:

আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজো

দেবীপক্ষ পড়লে বাড়ির কুমারী মেয়েদের পরতেই হবে শাঁখা। পলা বা লোহা পরতে পারবে না অবশ্য। এই রীতিই প্রচলিত বাংলার এক প্রাচীন পরিবারে। কারণ, মা দুর্গাকে সেখানে দেখা হয় বাড়ির মেয়ে হিসেবে। তাঁর প্রতীকস্বরূপ অবিবাহিত মেয়েদের হাতে ওঠে শাঁখা, থাকে দেবীপক্ষ পর্যন্ত।

Advertisement

কবে, কেন এই রীতি শুরু হয়েছিল, আজ আর মনে নেই রামশরণের উত্তর প্রজন্মের। এই রামশরণই পত্তন করেছিলেন পারিবারিক দুর্গাপুজোর, আজকের আন্দুলে সরস্বতীর তীরে কোনও এক আটচালায়। তখন অবশ্য অপভ্রংশ হয়ে জায়গার নাম ‘আন্দুল’ হয়নি। নাম ছিল ‘আনন্দধূলি’। যে নামকরণ হয়েছিল রামশরণের ঠাকুরদা কৃষ্ণানন্দর সময়ে। সে সময়ে ওই জনপদে পদধূলি পড়েছিল মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দের। সেই উপলক্ষ্যেই জনপদের নতুন পরিচয় হয় ‘আনন্দধূলি’। যার অপভ্রংশ ‘আন্দুল’। নিত্যানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন কৃষ্ণানন্দ।

তবে ঐতিহ্যের শিকড় গিয়েছে আরও অনেক গভীর অবধি। একাদশ শতকে সেন বংশের শাসনের সময় কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে বাংলায় পাঁচ ব্রাহ্মণ বংশের পাশাপাশি এসেছিল পাঁচ ক্ষত্রিয় বংশও। সেই পাঁচ ক্ষত্রিয় বংশের অন্যতম এই দত্তচৌধুরীরা। তাঁদের বংশের পুরষোত্তম দত্ত বাংলার বালি গ্রামে এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। তাঁর উত্তর প্রজন্মের তেকড়ি দত্ত বালি থেকে বাস উঠিয়ে চলে যান যে জনপদে, পরবর্তীকালে তারই নামকরণ হয় আন্দুল। বাংলায় সুলতানি শাসনের সময় দ্বিতীয় সুলতান সিকন্দর শাহ এই পরিবারের উত্তরপুরুষ প্রতিপত্তিশালী দেবদাস দত্তকে ‘জমিদার’ ঘোষণা করেন এবং নতুন উপাধি দেন ‘চৌধুরী’। বংশের নতুন পরিচয় হয় ‘আন্দুলের দত্তচৌধুরী’।

Advertisement

পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন রামশরণ দত্তচৌধুরী। ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দের জাতক কৃতীপুরুষ রামশরণ প্রয়াত হন ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। তবে ঠিক কোন বছরে তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন, তার লিখিত নথি পরিবারে নেই। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে আন্দুলের দত্তচৌধুরীদের পারিবারিক পুজো বাংলার প্রাচীন সাবেক পারিবারিক দুর্গোৎসবের মধ্যে অন্যতম।

চারশো বছরের প্রাচীন সেই পুজোয় আজও আসেন ঘরের মেয়ে। বিগ্রহে মহিষাসুরমর্দিনী হলেও দত্তচৌধুরী পরিবারে তিনি ঘরের মেয়ে, উমা। ষষ্ঠীতে তাঁকে সবুজ ওড়না পরিয়ে দেন বাড়ির মহিলারা। দশমীতে ওড়না পাল্টে যায়। সবুজের পরিবর্তে আসে লাল ওড়না। এই রীতি পালিত হয়ে আসছে কয়েক শতক ধরেই। পালিত হয়ে আসছে সাবেকিয়ানার অন্যান্য নজিরও। কালের স্রোতে কিছু হয়তো ভেসে গিয়েছে ঠিকই। সন্ধিপুজোয় কামানের শব্দ বা দশমীতে নীলকণ্ঠের ডানা, কোনওটাই আর বাতাসে ভাসে না। কিন্তু এখনও নিয়ম মেনে দত্তচৌধুরীর বাড়ির পুজোর ভোগে সাজানো হয় পুরীর জিবেগজা। জিবেগজা ও খাজা ছাড়া এই বাড়ির পুজোর ভোগ অসম্পূর্ণ। সেইসঙ্গে নারকেল নাড়ু, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মনোহরা-সহ মিষ্টান্ন ভোগের বৈশিষ্ট্য হল ‘আগমণ্ডা’। দেবীর মহানৈবেদ্যর মাথার উপরে দেওয়া হয় আগমণ্ডা। ভিতরে থাকে মেওয়া, নারকেলবাটা আর ক্ষীরের পুর। চন্দনী ক্ষীর দিয়ে মোড়া এই মণ্ডার চুড়ো সাজানো হয় পেস্তা, বাদাম ও কিসমিস দিয়ে। বানানো হয় নারকেল আর ক্ষীর দিয়ে। উপরে থাকে মেওয়ার পরত। পাশাপাশি, পুজোর প্রতি দিনই নিবেদিত হয় অন্নভোগ। তবে সাদা ভাত নৈব নৈব চ। দেওয়া হয় খিচুড়ি বা পোলাও।

প্রথমে এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় বলি হত। কিন্তু কোনও এক প্রজন্মে বাড়ির কর্তা স্বপ্নাদেশ পান, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার এই পরিবারের দুর্গাপুজোয় পশুবলি বন্ধ করার। তারপর থেকে বাড়ির ঠাকুরদালানে আর পড়েনি বলির রক্ত। পুজোর ভোগ সম্পূর্ণ নিরামিষ। সেই ভোগ যখন পুজোর চার দিন পরিবেশন করা হয়, তখন সদস্যরা মুখে এক বার হলেও বলেন, ‘রামশরণের কড়াই ধর’। এই অদ্ভুত রীতির পিছনে আছে পুরনো তিক্ত স্মৃতি। অতীতে এক বার শরিকি বিবাদে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল এই পরিবার। সেই দুর্দিন যেন আর না হয়, তাই এখনও বলা হয় ওই তিনটে শব্দ। যাতে রামশরণের উত্তর প্রজন্মের হেঁসেলে কোনও দিন অনটন না আসে।

পরিবার থেকে অশুভ কালো ছায়াকে দূরে রাখতে আরও একটি রীতি পালিত হয়ে আসছে বহু শতক ধরে। নবমীর সকালে প্রতিমার সামনে কালি প্রদীপের আরতি করেন পুরোহিত। মোট ২৮টি প্রদীপ নিয়ে আরতির পরে তা উল্টে রেখে নিভিয়ে ফেলা হয়। একেই বলা হয় কালি প্রদীপের আরতি। নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো এবং ধুনো পুজোও। পরিবারের মঙ্গলকামনায় মাথায় জ্বলন্ত ধুনি নিয়ে বসেন বাড়ির বধূরা।

এ ভাবেই কয়েক প্রজন্ম ধরে সনাতনীকে আবাহন করে হয়ে আসছে দত্তচৌধুরীদের বাড়ির পুজো। রামশরণ যে বাড়িতে পুজো শুরু করেছিলেন, সেই বাড়ি ছেড়ে বহু যুগ আগেই অন্য অন্য ঠিকানায় চলে গিয়েছেন দত্তচৌধুরীরা। সেখানে আদি ভদ্রাসনের নামমাত্রই আজ অবশিষ্ট। পরিবারের সদস্যরা আজ তিনটি বাড়িতে বিভক্ত। তবে সব ভেদাভেদ মুছে যায় আগমনীর সুরে। আন্দুলের পাশাপাশি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেও প্রাচীন ঠাকুরদালানে পা পড়ে পরিবারের শাখা প্রশাখার। বিজয়া দশমীর পরে আবার অপেক্ষা শুরু। নিঃসঙ্গ ঠাকুরদালান এবং এর কড়িবরগার বাসিন্দা পায়রাগুলিরও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement