প্রতীকী ছবি
ছেলেবেলায় আমাদের পাশের বাড়ির দিদা একটা ছড়া শিখিয়েছিলেন, ‘গণেশ ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসেন মায়ের সঙ্গে, একবার আসেন একলা!’ কিন্তু একলা তো নন, ডজনে-ডজনে, শয়ে-শয়ে গণেশ ঠাকুর আসছেন! এমনটা কি আগে হত? হেঁয়ালি ছেড়ে ব্যাপারটি খুলে বলাই যাক !
শোভাবাজার মেট্রো থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। লাল মন্দিরের সামনে দিয়ে যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ পার হয়ে বাঁ দিকে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে ঢুকে পড়লেই দিব্যি ঠাহর হয় এ এক অন্য গ্রহ!
গ্রে স্ট্রিট বা বি কে পাল অ্যাভিনিউ দিয়েও যাওয়া যায়। কয়েক শো গজের ফারাক, অথচ প্রত্যেকটা রাস্তার ইতিহাস, ভূগোল এমনকি মেজাজও আলাদা!
সকালের রোদ পিঠে মেখে নবকৃষ্ণ স্ট্রিট সিধে গিয়ে পড়েছে রবীন্দ্রসরণিতে। সেখান থেকে ডান দিকে উত্তর মুখো ট্রামলাইন বরাবর বড় জোর দেড়শো মিটার। সেখান থেকে বাঁ দিকে বনমালি সরকার স্ট্রিটে ঢুকে পড়লেই কুমোরটুলি। তবে এই রাস্তাটা একটু যেন কেতাবি। আনুষ্ঠানিক!
আর একটু রয়ে সয়ে, রসিয়ে রসিয়ে যেতে হলে অন্য রাস্তা ধরতে হবে। সাহেবরা যাকে বলে ডিট্যুওর! চক্কর। রাস্তাও ঠিক নয় গলি। নন্দরাম স্ট্রিট, কৃপানাথ লেন, কৃষ্ণ কুন্ডু স্ট্রিট।
এই গ্রহের কোনও কোনও প্রান্তে গন্তব্য আর গমন পথের মধ্যে একটা অদৃশ্য ডার্বির লড়াই রোজ চলতে থাকে! এই অঞ্চলটাও ঠিক তাই! তো, মন্দিরের বহিরঙ্গের কারুকাজ পেরিয়ে যেমন গর্ভগৃহে ঢুকতে হয়, এও তেমনি!
কুমোরটুলি যদি হয় মন্দিরের গর্ভগৃহ, এই অলিগলি চলিরাম, ফুটপাথে ধুমধাম রাস্তা গুলিও যেন ঠিক সেই রকম বহিরঙ্গের কারুকাজ! প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু ঘটে চলেছে, চলচ্চিত্রের মতো। সেখানে কুশীলব আর প্রেক্ষাপটের মেলবন্ধনটা চোখে পড়ার মতো!
রাস্তার একপাশে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন রুগ্ন এক জাদুকর, তাঁকে ঘিরে একটা ছোট্ট জটলা। অতিরুগ্ন একটা বেড়াল ছানা দর্শকদের পায়ের ফাঁক গলে সটান উঠে পড়ল জাদুকরের পাতা কাপড়ে! পড়ে থাকা খুচরো টাকা পয়সার ওপরে!
বিরক্ত জাদুকর, এই পাণ্ডুলিপি বহির্ভূত অনুপ্রবেশে বেশ বিরক্ত হলেন! ঘাড় ধরে তুলে পাশে সরিয়ে দেবার সময় লক্ষ্য করলাম দু’জনের মুখের অভিব্যক্তিটা এক! আর সেটা খিদের! পাশের অবিন্যস্ত দাওয়ায় এক উত্তর-চল্লিশ মহিলা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে দু’হাত আকাশে তুলে ভারী বিরক্ত-ভঙ্গিতে তাড়িয়ে চলেছেন ওই আকাশে ভেসে চলা আস্ত একটা উড়োজাহাজ।
পুজোর আর মাস দেড়েক বাকি। জনশ্রুতি এই যে, সেকালে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গা পূজার প্রচলন করেন। পরে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর থেকে কুমোররা ভাল আয়ের আশায় এই কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় দুর্গা পূজা শুরু করেন।
ছয় শতাব্দী পেরিয়ে কুমোরটুলির আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি! দুর্গা প্রতিমা বায়না আসে আমেরিকা, কানাডা ছাড়াও, ইংল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ইতালি, মালয়েশিয়া, সুইডেন, এমনকি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে! অথচ কুমারটুলিতে ঢুকতেই যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে সেটা হল, অসংখ্য গণেশ মূর্তি! আর তার অনেক গুলিই কিন্তু বিশালাকৃতির!
অথচ গণেশ চতুর্থীর আগেই বিশ্বকর্মা পুজো! কিন্তু গেলেন কোথায় স্থাপত্যবিদ, দেবশিল্পী বিশ্বস্রষ্টা দেব বিশ্বকর্মা! প্রায় মিসিং ডাইরি করার মতো অবস্থা!
নেট খুলে দেখে নিলাম তাঁর বৃহস্পতির ভগিনী যোগসিদ্ধা তাঁর মাতা এবং অষ্টম বসু প্রভাস তাঁর পিতা। বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। অথচ শ্রমজীবী মানুষের আরাধ্য দেবতাটি কি এই মুহুর্তে একটু কয়েক গোলে পিছিয়ে! নিঃশব্দে তাঁর স্থান নিয়ে নিয়েছেন বাণিজ্যের প্রতীক, সিদ্ধিদাতা একদন্ত বৃকোদর গণেশ! বিশ্বকর্মা কেন! সিংহবাহিনী দশভুজার মূর্তির চেয়ে একদন্ত পার্বতীপুত্র এই মুহূর্তে সংখ্যায় এগিয়ে!
শিল্পী তারক পাল তো বলেই দিলেন, এসব হল শখের পুজো! নিউ তারকনাথ স্টোর্সে শোনা গেল, ২০ খানা বিশ্বকর্মা হলে, গণেশ হচ্ছে অন্তত ৩ গুণ! আর তার অনেকগুলিই অতিকায় ! বিস্ময় প্রকাশ করতে এগিয়ে এলেন প্রৌঢ় মুরারী বাবু,। হেসে বললেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিকে কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়িয়ে দেবেন স্যার, নতুন কারখানা হতে দেবেন না তো বিশ্বকর্মা আর কি করবেন! যেখানে শিল্পই নেই সেখানে বিশ্বকর্মা আসবেন কেন?’
এটা স্যার বাণিজ্যের যুগ, অনলাইন, অফলাইন, সবই বাণিজ্য, তাই সিদ্ধিদাতাই সই! আর ভাল করে দেখুন, ইনি কিন্তু লালমুখ সাদা অঙ্গ গণেশ ঠাকুর নন! ইনি হলেন গণপতি বাপ্পা!
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।