pickpocket

পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!

জানেন কি পকেটমার কয় প্রকার ও কী কী? তাদের কৌশলই বা কী?

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ১২:৫৬
Share:

পুজো স্পেশাল পকেটমাররা অপারেশনের সময় নিজেদের হাতে একাধিক শপিং ব্যাগ রাখে। অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

পুজোর ঠিক আগে আগে রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারগুলো রঙের পোঁচড়া পড়ে রঙিন হয়ে ওঠে। রাস্তার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ধূলিধূসর গাছগুলোর গা জড়িয়ে ধরে রংবেরঙের টুনিবাল্‌ব্‌। গেরস্তবাড়ির তক্তপোশের ময়লা গদির উপর পাতা হয় ফুলফুল নতুন চাদর। ঘরে ঢুকলেই মনে হয়— এ যেন অন্য কারও বাড়ি, অন্য কারও বিছানা!

Advertisement

পুজোর সময় ঠিক এই ব্যাপারটাই দেখা যায় কলকাতার পকেটমারদের বেলাতেও।

রোগাটে চেহারা, রংজ্বলা জামা-প্যান্ট, গালে গুঁড়োগুঁড়ো দাড়ি— হাতসাফাই করতে গিয়ে পাবলিক বাসের যাত্রীদের হাতে চড়চাপড় খাচ্ছে— এমন পিকপকেটারদের আমরা ‘বারোমেসে পকেটমার’ বলে থাকি।

Advertisement

কিন্তু ‘শারদীয়া পকেটমার’ বা পুজো স্পেশাল পকেটমারদের চেহারা, চালচলন, পোশাকে-আশাকে একটা অন্য ধরনের অ্যাপিল থাকে। এদের মুখের বাংলায় কোনো ‘স’-এর টান থাকে না। ইংরিজি ও হিন্দিতেও এরা চোস্ত। শহরটায় মূলত বাঙালি বেশি হলেও নিজেকে উঁচু ঘরানার মানুষ বোঝাতে গেলে যে এই দু’টি ভাষার মিশেলে কথা বলতে জানতে হবে— সেটা ওরা ভালই জানে।

আরও পড়ুন: আঁচলে অ্যাত্তোখানি আর খোল এত ফাঁকা!

পুজো স্পেশাল পকেটমাররা অপারেশনের সময় নিজেদের হাতে এক বা একাধিক ব্র্যান্ডেড কোম্পানির শপিং ব্যাগ রাখে। এতে হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেই পকেটমারও এক জন উৎসাহী খরিদ্দার। আর মহিলা পকেটমারদের হাতে ওই শপিং ব্যাগগুলি ছাড়াও থাকে একটি ফ্যাশনেবল ভ্যানিটি ব্যাগ। তাতে থাকে কিছু লুকনো পকেট। ব্যাগের মধ্যে কোনও চোরাই জিনিস টুক করে একবার ফেলে দিতে পারলে, সেটা খুঁজে বার করতে খোদ পি সি সরকারেরও ঘাম বেরিয়ে যাবে।

পুজোর পকেটমারদের মূল টার্গেট হল পুজো মার্কেটিং করতে বেরনো সেই সব মানুষ, যারা তাদের অঢেল টাকা কী করে খরচ করবে বুঝে উঠতে পারছে না! মধ্যবিত্ত চাকুরে বা শ্রমিক, যারা সারা বছর তিল তিল করে জমানো টাকা নিয়ে মা-বোন-বাচ্চাদের জন্য পুজোর জামা কিনতে বেরিয়েছে, তারা রাস্তায় বেরলেই সেই টাকা আগলে রাখে জামার ভেতরে থাকা লুকনো বুকপকেটে। আর তা নইলে ফুলপ্যান্টের কোমরের ভেতরের গুপ্তপকেটে।

ভিড় বাসে উঠে নিজের বুকপকেটের উপরটা ঘনঘন ডলা দিতে থাকলে কিংবা সিরাজ-উদ-দৌলার মতো নিজের কোমরবন্ধে সন্দিগ্ধ ভাবে মাঝে মাঝে হাত বোলালে, সেটা সহজেই ধরা পড়ে যায়। ফলে পকেটমারদের পক্ষে তাদের টার্গেট করতে সুবিধা হয়। এই পকেটমাররা কিন্তু মোটেই ‘শারদীয়া-পকেটমার’ নয়— এরা হল ‘মাসকাবারি পকেটমার’। মানে, মাস কাবার হলে যারা মানুষের মাইনে সাফ করতে ওস্তাদ।

আরও পড়ুন: পুজোর বেড়ানো জমে উঠুক, সঙ্গে থাকুক ফার্স্ট এড বক্স

মানিব্যাগের বেলায় ‘পুস-আপ’ সিস্টেম। অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

পুজোর বাজারের কিছু অভিজ্ঞ পকেটমারের অমৃতবাণী থেকে জেনেছি, এই সিজনে তারা দু’টি ট্রিক সবচেয়ে বেশি অ্যাপ্লাই করে থাকে। মানিব্যাগের বেলায় ‘পুস-আপ’ সিস্টেম। মানে, হিপ পকেটে মানিব্যাগ থাকলে, বাইরে থেকে পকেটের ঠিক তলায় নিজের বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে আলতো চাপ দিলে, ব্যাগের মাথাটা ‘টুকি’ বলে উপরে উঁকি দেয়। তখন তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ফরসেপের স্টাইলে ব্যাগটা সন্তর্পনে তুলে নেওয়া। আর ভ্যানিটি ব্যাগ বা কাঁধের অফিসব্যাগের ক্ষেত্রে ‘ওপেন দ্য স্কিন’ সিস্টেম। মানে, খুব পাতলা আর ধারালো ব্লেড দিয়ে শরীরের নরম চামড়া কাটার স্টাইলে, ব্যাগের গা চিরে ভেতরের সব কিছু বার করে আনা।

গড়িয়াহাট বা হাতিবাগানের মতো ভিড়ের রাস্তা, যার দু’দিকে পুজোর বাজার বসেছে, এমন রাস্তা পুজোর পকেটমারদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ধরুন, একটা শাড়ির দোকানে টেবিলের উপর বিছিয়ে শাড়ি দেখা চলছে। কোনও শাঁসালো খদ্দের হয়তো দ্বিতীয় সারিতে রয়েছেন, হাতে ধরে-টিপে-ঘষে মনের সুখ করে শাড়ি দেখার বা ঘাঁটার সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ কাঁধের ক্যামেল লেদারের গ্রে কালারের দামি ব্যাগটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তার পেটে যথেষ্ট মালকড়ি রয়েছে।

এক জন দুঁদে পকেটপার সব সময় এমন ক্রেতাকে ভদ্রতা দেখিয়ে, ‘প্লিজ, আপনি সামনে এসে দেখুন, আমার হয়ে গেছে!’ বলে নিজের ঠিক সামনে এগিয়ে দেবে। ঠাসা ভিড়ে এমন একটা সুবর্ণ সুযোগ পাওয়ায় ভদ্রমহিলা একটি আড়াইমনি ওজনের ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ মার্কা হাসি দিয়ে, সামনে এগিয়ে যেই না শাড়ি ধামসানো শুরু করবেন, অমনি পেছন থেকে তাঁর ব্যাগের পিঠে প্লাস্টিক সার্জেনের ব্লেড সাঁইসাঁই করে চলবে।

আরও পড়ুন: পুজোয় বেড়াতে যাচ্ছেন? বাড়ির বাইরে থেকেই গাছেদের যত্ন নিন এ ভাবে

এ তো গেল টাকা-পয়সা। এ বার আসি মোবাইল ফোনের ব্যাপারে। শাড়ি-জামা দেখতে দেখতে এই পুজোর সময় যে কত দিদি-বউদি তাদের হাতের মোবাইল দোকানের শাড়ি রাখা টেবিল বা ঘাঘরা-চোলির তাকের উপর ফেলে রেখে ভুলে যায়, তার ইয়ত্তা নেই। সিসিটিভি ক্যামেরা সেগুলো ধরতে পারে ঠিকই । কিন্তু একপাঁজা সালোয়ারকে যদি সেই মোবাইলটির উপর ও সঙ্গে সঙ্গে রেখে, তার পর সবসুদ্ধু মুঠো করে তুলে নেওয়া হয়, তখন সিসিটিভিরও ‘ব্যোম ভোলে’ হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভবনা থাকে।

পুজোর পকেটমাররা কখনওই একলা ঘুরে বেড়ায় না। ঘোরে একটা টিম-এ। তাদের এক জনের সঙ্গে আর এক জনের চোখের ইশারায় যোগাযোগ থাকে। মুহূর্তের মধ্যে মানিব্যাগ, ওয়ালেট বা দামি মোবাইল এক হাত থেকে ম্যারাথনের ব্যাটনের মতো চলে যায় অন্য হাতে। তার পর তা বেরিয়ে যায় এলাকা ছেড়ে। পকেটমারদের নিজস্ব এলাকা তো সেই শিবাজির আমল থেকেই পরিষ্কার ভাগ করা আছে। তাই তা নিয়ে কোথাও কোনও সমস্যা তৈরি হয় না। যে এলাকার জিনিস সব সময় সেই এলাকায় ঠিকঠাক পৌঁছে যায়। সিসিটিভি দেওয়া শপিং মলগুলোতে কীভাবে ক্যামেরাকে ধোঁকা দিয়ে অপারেশন চালাতে হবে— তার আলাদা কোচিং দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে।

আরও পড়ুন: শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো প্যান্ডেলের পারিজাতকে ভাল লাগার শুরু

অল্পবয়সী কাস্টমার, মাঝবয়সী কাস্টমার এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের টাকা হাতানোর থিয়োরি, প্র্যাকটিকাল এবং ডেমো সম্পূর্ণ আলাদা। ফি বছর পুজোর সময় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাঁচি, গয়া— এমন নানা জায়গার কিছু প্রথিতযশা পকেটমার কলকাতায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পদধূলি দেয়। এরা কলকাতায় সেই বছরের অপারেশন প্ল্যানিং সেট করে। ফলে এখানকার পকেটমার সঙ্ঘের যে কী উপকার হয় তা বলে বোঝানো যায় না! কারণ এও তো এক ধরনের সংস্কৃতির আদানপ্রদান। পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!

আসলে আমার মনে হয়, পুজোর পকেটমারদের সবার আগে বুঝতে হয় তাদের টার্গেটের সাইকোলজি। সে টাকাটা নিয়ে কোথায় রাখছে, কী ভাবছে, কোথায় যাবে তা নিয়ে একটু কনফিউজড কি না— এটা না বুঝলে যে কোনও অপরেশনই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আজ থেকে বছর চারেক আগে সপ্তমীর দিন সন্ধেবেলায় সপরিবার ঠাকুর দেখতে কলেজ স্কোয়ারে গেছি। ছেলে তখন ক্লাস সেভেন। ওর হাতে আমার ছোটমতো দ্বিতীয় মোবাইলটা দিয়েছিলাম সাবধানে পকেটে রাখতে। যদি আমাদের খুঁজে না পায়, ফোনে অন্তত যোগাযোগ করতে পারবে। প্রায় ঘণ্টাখানিক পরে, পুরো জায়গাটা চক্কর মেরে, ঠাকুর দেখে, ছেলে প্রায় আমাদের সঙ্গেই ঠিকঠাক বেরিয়ে এল। কিন্তু, মোবাইলটা বেরিয়ে এল না। কোনও পকেটমারভাই আমাদের দূর থেকে লক্ষ করেছিলেন নিশ্চয়ই। তিনিই ওটার সদগতি করেছিলেন।

পুজোর পকেটমার নিয়ে আর একটি কাহিনি না বললে অন্যায় হবে। আমাদের মিত্র স্কুলের লাইফ সায়েন্সের মাস্টারমশাই তুহিন মণ্ডল আটের দশকের শেষ দিকে বসুশ্রী সিনেমার পেছন দিকের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। স্যরের প্রিয় পোশাক ছিল ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি। লম্বা-চওড়া চেহারা ছিল বলে এতে তাঁকে মানাতও খুব। সে বার পুজোর ঠিক আগে এক সন্ধেবেলায় হাজরা পার্কের সামনে তাঁর মানিব্যাগটি পকেট থেকেই চুরি হয়ে গেল। ব্যাগে টাকা-পয়সা খুবই কম ছিল, খুব জোর টাকা দশ-বারো। কিন্তু ছিল কিছু জরুরি কাগজপত্র এবং একটি ফোনবুক। স্যর পরের দিন ক্লাসে এসে আমাদের কাছে সে কথা বলেছিলেন।

আরও পড়ুন: পুজোয় সময় বাঁচিয়ে ঠাকুর দেখতে চান? তবে সঙ্গে থাকুক এ সব

আর ঠিক সেই দিনই সন্ধেবেলায় ঘটেছিল এক আশ্চর্য ঘটনা। রাতে নিজের ঘরে ফিরে পাঞ্জাবি ছাড়তে গিয়ে স্যর দেখেছিলেন, সেই চুরি যাওয়া মানিব্যাগটি তাঁর পাঞ্জাবির পকেটেই আবার ফিরে এসেছে। টাকা-পয়সা কিছু নেই কিন্তু কাগজপত্র সব রয়েছে। রয়েছে সেই ফোনবুকটাও। আর রয়েছে লম্বাটে একফালি কাগজ, যাতে গোটা গোটা করে লেখা একটি চিরকুট। ‘মানিব্যাগ ব্যবহার করিলে তাহাতে কিঞ্চিৎ অর্থ রাখিবেন। নচেৎ উহা ব্যবহার করা অর্থহীন!— বিনীত শুভাকাঙ্ক্ষী।’

আমার মনে আছে, সেই ফালি কাগজটা ক্লাসের সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখেছিলাম। আর তুহিনবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘দেখ, একটাও বানান ভুল করেনি কিন্তু !’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement