Kasushik Kar Interview

ভেবেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেব, বাঁচিয়ে দিল নাটকটা : কৌশিক কর

মঞ্চ থেকে পর্দা। তাঁর বিচরণ সর্বত্র। মুখফোঁড় হিসেবেও তাঁর নাম আছে। তাঁর লড়াকু জীবন একটা উপন্যাস। প্রাণখোলা আলাপে তিনি। সামনে আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

আনন্দ উৎসব ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৭
Share:

আপনি কি অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে হিংসে করেন?

Advertisement

হঠাৎ এ প্রশ্ন?

আসলে দৌড়টা এক সঙ্গে শুরু। একটা সময় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে আপনি মুখ্য চরিত্রে। উনি পার্শ্ব অভিনেতা। তার পর ও আজ মেগা স্টার, আর আপনি...

Advertisement

একটু ভুল বললেন। চন্দ্রগুপ্তের আগে দু’টো নাটক, ‘রাজা লীয়র’ ও ‘দেবী স্বর্পমস্তা’ থেকেই ও আপনার ভাষায় ‘মেগাস্টার’!

সে তো হল, কিন্তু শেষমেশ গল্পটা তো একই!

দেখুন, আমি ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখিই না। এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের দু’টি অবস্থান আছে। একটি হল ‘এক’। অন্যটি হল ‘শূন্য’। ‘এক’কে দেখা দেখা যায়, ‘শূন্য’কে নয়। সেই অর্থে আমি নয় ‘শূন্য’। অনির্বাণ ‘এক’।

এ সব ভাবের কথা বাদ দিন। সোজাসাপ্টা বলুন। ‘মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজিতে’ অনির্বাণ অনেক এগিয়ে। আপনি উদ্ধত, রগচটা, সমাজমাধ্যমে দুমদাম মন্তব্য করেন!

দেখুন, শিল্পের জন্য শিল্প করাতে আমি বিশ্বাসী নই। মঞ্চকে, সিনেমাকে হাতিয়ার করে আমি ‘প্রপাগান্ডা’সুলভ কাজে বিশ্বাসী। তাতে যদি আমার ‘মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি’ ভুল হয়, হবে। এই সব ‘মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি-ফ্যাটিজি’ ক্ষমতাবান বা সর্বগ্রাসীদের গল্প। যার বিস্তার হয় পাশাপাশি। উপরের দিকে নয়। মানে, উত্তরণ নয়।

ও! কিন্তু লোকে কিন্তু বলে আপনি ‘হিন্দুত্ববাদী’দের দলে নাম লিখিয়েছিলেন! সেখানে...

ওই দল হিন্দুত্ববাদী কিনা, তাতে আমার খটকা আছে। আমার মনে হয়, ওটাও একটা ‘স্ট্র্যাটিজি’ বা কৌশল। তার অনেক কিছুই আমার পছন্দের নয়।

আরে বাবা! নাম তো লিখিয়েছিলেন!

দেখুন, আমি আদ্যন্ত বামপন্থী। কিন্তু এটা আমার একটা ব্রাহ্মণ্য নীতি ছিল বলতে পারেন। চাণক্যর মতো। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ব্যাপার। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, এই নীতি। আমাদের ইতিহাসও তাই বলে। নেতাজি তো হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।

এর কারণে কিন্তু আপনার অনেক বন্ধু আপনাকে ত্যাগ করেছিল! ‘বীতশ্রদ্ধ’ হয়েছিল!

ওই সব বন্ধুরা তার অনেক আগেই আমায় ত্যাগ করেছিল! আর বীতশ্রদ্ধ? সে আমি অনেক আগেই হয়েছিলাম।

মানে! কেন?

আমি ‘কুকুরের লেজ’ বলে একটা নাটক করতাম। সেখানে এক দিনের গল্প বলি। প্রেক্ষাগৃহে প্রায় ১২০০ দর্শক। নাটকে আমি মানুষের দুর্দশার গল্প বলছি। লোকে দেখলাম হাততালি দিচ্ছে। একটা সময়ের পর আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমাকে লোকে বিনোদনের পাত্র হিসেবেই দেখছে। এই ‘বিনোদনের ছক’টা যারা ধরে ফেলে এবং তাতে আনন্দ পায়, আমি সে দলে পড়ি না।

যাব্বাবা! আপনিও কি বিনোদনকে হাতিয়ার করতে চাননি?

বিনোদনটা কী করে হাতিয়ার হবে! আমি যে পরিবর্তনের কথা ভাবি, সেখানে বিনোদন কোনও উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারে না।

বুঝলাম। এ বার বলুন, কৌশিক কর নিজেকে কী করে বর্ণনা করবেন?

বামপন্থার যাপনে থাকা মানুষ...

এ ভাবে নয়। সহজ করে বলি, আপনার বেড়ে ওঠা, আপনার বাবা, আপনার ...

বাবা নকশালপন্থী রাজনীতি করতেন। সংসারটা গুছিয়ে কোনও দিনই করতে পারেননি। মা একটি মিশনারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আমি সেই মিশনে মানুষে হয়েছি।

ছোট বেলায় আপনাকে মায়ের সঙ্গে গোয়াল ঘরেও কাটাতে হয়েছে! সত্যি?

হুম। গোয়াল ঘরে চট পেতে শুয়েছি। লোকের বারান্দায় থেকেছি। কিছু দিন অনাথ আশ্রমেও! তখন আমাদের সংসারে খাওয়াদাওয়া থেকে আমার পড়াশুনোর বই কেনা, সবেতেই অভাব। পড়াশুনোয় ভাল ছিলাম বলে, আশ্রমে আমাকে নানা রকম সুবিধে দেওয়া হত।

বড় হওয়াটা কোথায়?

প্রথমে ২৪ পরগনায়। তিনটে স্কুলে আমি পড়াশুনো করেছি। তার পরে কৈশোর বেলাটা বহরমপুরে। সেখানকার স্কুল, কলেজ। তার পর কল্যাণী। স্নাতকোত্তর পাস করে, বিএড করার পর সোজা ‘মিনার্ভা রেপার্টারি’। তার পর তো নাটক, নাটক, নাটক। বাংলায় ছবি করা, মুম্বইতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়া...

আপনার এত গুলি নাটকের মধ্যে যদি জনপ্রিয়তম বলতে হয়, কোনটার নাম বলবেন?

আমার সব নাটকই জনপ্রিয়। তার মধ্যে দু’টির নাম করব। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা এবং অটো।

এখানে অনির্বাণ-প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা কথা বলে নিই। ওঁর ‘স্ক্রিন প্রেজেন্স’, তীক্ষ্ণ নাসা, পরিশীলিত উচ্চারণ একটা সম্পদ। এগুলি কি আপনাকে পিছিয়ে দেয়নি?

না, না। একদমই তা নয়। সারা পৃথিবীর বিনোদনের ইতিহাসে নায়ককে দর্শক এ ভাবে দেখে না। সেটা বলিউড বা টলিউডের ক্ষেত্রেও সত্যি। অনির্বাণের চেয়ে হাজার গুণ সুপুরুষ ‘ইন্ডাস্ট্রিতে’ এসেছে। তাদের অনেকেই কিছু করতে পারেনি। এ সব বললে, অনির্বাণের গুণপনাকে অস্বীকার করা হয়।

অন্য কথায় যাই। এত নাটক করে সিনেমা করতে গিয়েছিলেন কেন? সে’ও কি বীতশ্রদ্ধ হয়ে?

ওই যে বিনোদনের চক্কোর, বললাম না! আমি মঞ্চে দুর্দশাগ্রস্ত চাষির অভিনয় করছি, তাতেও হাততালি। যে চাষিটা জীবনেও এত ‘হাততালি’ পায় না, আমি পাই তার ‘নকল’ সেজে। একটা সময় মনে হচ্ছিল, আমি থিয়েটারে মৃত সন্তানের জন্ম দিচ্ছি। আমি সব ছেড়েছুড়ে, আমার চারটি ফুল-হাউস নাটক ফেলে, দেশে ফিরে চাষাবাদে মন দিয়েছিলাম।

আপনার পুত্র, আপনার স্ত্রীর কাছে...

হুম।

এ বার বলি, আপনি নিজেকে কতটা সফল পিতা মনে করেন?

সফল পিতৃত্ব কাকে বলে আমি জানি না। কিন্তু আমি ছেলেকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি।

স্ত্রীকে? তাঁর সঙ্গে তো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে শুনেছি!

আমাদের বাইশ বছরের সম্পর্ক। আমরা দু’জনেই লড়াই করে বড় হওয়া মানুষ। সেই সম্পর্ক কি ভোলার? আসলে আমার জীবনটা একটা সময়ে ভয়ানক বাঁক নিল। ছোটবেলা থেকে যে মানুষটা কলেজে জামা উড়িয়ে হুল্লোড় করেছে, পরে সমাজের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে এক পাত্রে খেয়েছে, প্রভূত নামডাক কুড়োচ্ছে, সেই মানুষটা হঠাৎ ‘চাষা’ হয়ে গেল! ধুলো, কাদা মেখে মাঠে লাঙ্গল ধরল। এই জায়গাটা ও হয়তো’বা আমার স্ত্রী মানতে পারেনি।

কিন্তু লোকে তো বলে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে নিবিড় প্রেম এই দাম্পত্যে চিড় খাওয়ার কারণ?

ব্যাপারটা এমন নয়। এ গুলি বাইরে থেকে দেখা যুক্তি। প্রত্যেকটি কর্মজীবনে একটি করে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। ধরুন, একজন ঝালাই মিস্ত্রি। তার একটা সময় চোখটা নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। শ্রমজীবীদের কথা ছাড়ুন। ধরুন, মাদাম কুরি ও পিয়ার কুরি। অত বড় একটা আবিষ্কারের জনক। অথচ তার জন্য তাঁদের ক্যান্সার হয়ে যাচ্ছে। তেমন, আমাদের জীবনে। আমি যত না বৌয়ের সঙ্গে থাকি, তার চেয়ে বেশি সময় কাটাই মঞ্চে আমার স্ত্রী সেজে ওঠা ‘স্ত্রী’ বা ‘বান্ধবী’র সঙ্গে। সেই নকল স্ত্রী বা বান্ধবী কখন যে ‘আসলের’ মতো হয়ে ওঠে, বোঝাই যায় না। অন্যরা যখন বলে, তখন টনক নড়ে।

আপনার হিন্দি সিনেমা ‘ছিপকালি’ মুম্বইতে করছিলেন। যশপাল শর্মাকে নিয়ে।

আমি তো প্রথমে নানা পাটেকরকে নিয়ে করব ভেবেছিলাম। নানা কারণে পিছিয়ে আসি। আর যশপালজির সঙ্গে থিয়েটারের কারণে আমার ‘টিউনিংটা’ দারুণ। ফলে, ওঁকে অনুরোধ করি। তবে, ছবিটা তো এখন আইনি জটে আটকে। আর ওই ছবিটা নিয়ে আমার বিরাট কিছু আবেগও নেই। বরং, ‘ফটাস’ বলে যে ছবিটা করছি, সেটা আমার অনেকটাই মনের কাছাকাছি।

‘ফটাস’?

হ্যাঁ। ফটাস। ফটাস হচ্ছে একটা মানুষ যে, এই সমাজের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। শারীরিকভাবে একটা মানুষকে মেরে ফেলার বিরোধী। ও একটা ক্যাপ বন্দুক নিয়ে ঘোরে। বাচ্চাদের খেলনা পিস্তল যেমন হয়। সেটা ও ফাটায় ‘ফাটাস ফটাস’ করে!

বহুদিন বাদে মঞ্চে ফিরেছেন। ‘বিশ্বরূপম’ নাটকটা নিয়ে।

হ্যাঁ।

বিষয়টা একটু বলবেন?

বিশ্বরূপম হচ্ছে একটি মানুষ যখন নিজের ‘জার্নিকে’ স্তব্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবে, তার কথা। যেমন, অর্জুন। একদম কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যখন লড়াই করতে গিয়ে তিনি দেখছেন যে, তাঁকে যাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হচ্ছে, সবাই তাঁর পরিজন, তিনি থমকে যান। আবার গীতা পাঠ করলে, ওই অর্জুনের কর্ম থেকে পিছিয়ে আসার উল্টো দিকটা পাওয়া যায়। অর্থাৎ যে ভাবে মানুষ কাজে এগিয়ে যায়, আবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে ধর্ম স্থাপনের জন্য লড়াই করে।

শেষ প্রশ্ন, কৌশিক কর এক দিন আমাকে বলেন, তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন!

চেয়েছিলাম। সেটা কোনও দুঃখে বা হতাশায় নয়, নিজেকে নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছিল তখন। সেইখান থেকে দাঁড়িয়ে এই ‘বিশ্বরূপম’টা লিখি। তার আগে আমার মনে হচ্ছিল, আমার অস্তিত্ত্ব, কোনও কাজের লাগছে না প্রকৃতিতে। শক্তি তো রূপান্তরিত হয়। শক্তির ধ্বংস নেই। তাই আমার খোলসের মধ্যে থাকা শক্তি যদি মুক্ত হয়ে অন্য ভাবে কাজে লাগে। সেই রাতে এমন ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। তার পর এই নাটকটি লিখতে শুরু করি। বলতে গেলে, নাটকটাই আমায় জীবনে ফিরিয়ে দেয়।

যত্তসব ভুলভাল দর্শন। ভাল থাকুন। অনেক কাজ করুন।

হাহাহাহা...! এখন সত্যিই সামনে অনেক অনেক কাজ।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement