বন্যা কর
বাঙালির কাছে পুজো মানে যা যা কিছু, আমিও তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ছোট থেকে। বউবাজারে বাবার একটা খাবারের দোকান ছিল। পুজোর সময়ে দারুণ রমরমিয়ে চলত চাউমিন-বিরিয়ানির সেই দোকান। নতুন নতুন জামা পরে বাবার ফুড স্টলে বসে লোকের যাওয়া-আসা দেখতাম। একটু বড় হওয়ার পর দেখতাম অন্য ছেলেমেয়েরা মা-বাবার হাত ধরে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে। তখন মন খারাপ হত। আরও একটু বয়স বাড়ার পরে বুঝলাম, এই দোকান চালিয়েই বাবা আমাদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের মাইনে দেন, সুন্দর জামাকাপড় কিনে দেন। তাই একটা সময় পর্যন্ত এই গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল আমার দুর্গাপুজো।
ছোটবেলা থেকেই পুরুষ শরীর নিয়ে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু নারীদেহ প্রাপ্তির পর থেকে পুজো একেবারে অন্য রকম। নারী হয়ে ওঠার পরে প্রথম পুজোয় মনে আছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় হওয়া কত মানুষ যে আমায় শাড়ি দিয়েছিলেন! তখন সবে বাড়ি ছেড়ে একা থাকতে শুরু করেছি।
ছোটবেলায় পুজোয় মাকে শাড়ি বেছে দিতাম আমি, মায়ের বড় ছেলে। এখন সেই বড় ছেলে মৃত। আমি এখন বন্যা। মা কিন্তু আমায় শাড়ি বেছে দিতেন না। কষ্ট হত। একা লাগত। মায়ের শাড়ি থেকে নিজের শাড়ি, প্রত্যেক মেয়ের মতো আমারও যাত্রাপথ এটাই। মা যদি আমায় আরও একটু আগে বুঝতেন, তা হলে নারী হয়ে ওঠার এই যুদ্ধটা হয়তো একটু সহজ হত।
তবে মা এখন বুঝতে পারেন। মা জানেন, মায়ের বড় ছেলে আর নেই। বড় মেয়ে আছে, বন্যা। যে মা এক দিন আমার নেলপলিশ ফেলে দিয়েছিলেন, আমার প্রথম কেনা ব্রা লুকিয়ে ফেলেছিলেন, সেই মা-ই আমায় এখন বলেন, ‘‘নতুন ব্লাউজ কিনিস না। আমার থেকে নিয়ে যা… তোর সায়া লাগবে? নিয়ে যা।’’ গত বারের পুজোতেও মায়ের শাড়িই পরেছি।
তবে এ বারের পুজো অন্য রকম। উদযাপনের আমেজ নেই। পুজো হবে যদিও। যাঁদের খাওয়া-পরা পুজোর উপর নির্ভর করে, তাঁদের জন্যই সব কিছু স্বাভাবিক হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এ বার ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর স্লোগানও উঠবে। আমিও বেরোব পুজোয়। নতুন শাড়ি পরব। কিন্তু বুকে থাকবে প্রতিবাদের স্লোগানের ব্য়াজ।
আসলে বহু মেয়ের না বলা কথা, জমা ক্ষোভ এই আন্দোলনের আকারে নেমে এসেছে রাস্তায়। তাই পুজোর পাশাপাশি ন্যায় বিচারের দাবিদাওয়া চলবেই এ বারের পুজোতে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।