ছবি সংগৃহিত
দেখতে দেখতে প্রয়াসের পুজো দ্বিতীয় বছরে পা দিল। বিশ্বজুড়ে সুরে সুর মিলিয়ে এখানেও এবারের থিম নারীর ক্ষমতায়ন। এই বছর যেন নোটিস ছাড়াই পুজো এক্কেবারে হুড়মুড় করে এসে পড়ল। আকাশে, বাতাসে পুজো পুজো গন্ধও যেন উধাও! কিন্তু পুজো এলে বিশ্বজুড়ে বাঙালি বুঝতে পারে, বছরকার দিন এসে গিয়েছে। কাশবনে দোলা লেগেছে শীতের হাওয়ার। এখানেও প্যাম্পাস ঘাস দেখে দেশের জন্যেই মন কেঁদে ওঠে। ডুমডুমাডুম ঢাকের তালে বুকের ভেতর কেমন যেন তাথৈ তাথৈ নাচ। শতাব্দী প্রাচীন বিগ বেন ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং করে জানান দেয়, সময়ের গতি সেই সময় থমকে দাঁড়াবে মা দুর্গার বন্দনায়। প্রয়াসে এবার দ্বিতীয় বছরের পুজো। টেমস শহরের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্টেন্স শহরে হিথ সেন্টারও খেলবে সিঁদুর খেলা। ঢাকের তালে কোমর দুলিয়ে নাচবে কুচোকাঁচারা।
১৩ই অক্টোবর, প্রতিমা এসেছে কুমোরটুলি থেকে। এ বারে পুজোয় মধ্যমণি শুধু মেয়েরাই। শুধু পুজোর যোগাড় নয়, বাকি সব রকমের কাজেই শুধু মেয়েরাই এ বার সামনের সারিতে। নারীরা সব পারে। তাই তো আমরা মা কে দেখি বিশ্বেশ্বরী রূপে — ‘কখনও তাঁরা এলোকেশী সর্বনাশি/কখনও আবার নয়নে তার শাসন স্নেহের অমল হাসি।’ শুধু তাই নয় বাংলার ডোকরা, বালুচরি, কাঁথা স্টিচ কিংবা তাঁতের শাড়ি শোভা পাবে অসংখ্য বিধুমুখীর অঙ্গে। এখানেই প্রয়াসের উৎসব সকলের থেকে আলাদা। বাংলা ও বাঙালির হেরিটেজকে বাঁচানোর এক অনবদ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রয়াসের আন্তরিক প্রয়াস। শুধু তাই নয় ভোগের সম্ভারেও থাকছে পুরোপুরি বাঙালিয়ানা, সর্ষে ইলিশ বা লুচি আলুরদম থেকে শুরু করে রসগোল্লা।
বাঙালির দুর্গাপুজো কতশত স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। সামনে গেলে ভেসে আসে পুজোর গন্ধ। আচ্ছা, পুজোর গন্ধ কি বদলায়? সেই ধূপধুনো আরতির ঘিয়ের প্রদীপ, ক্রিসান্থিমাম লিলি সবই তো একই। তবু এখানে এলে ভেসে আসে পুরনো দিনের গন্ধ। মনে পড়ে দেশ ছেড়ে সদ্য আসা দিনগুলির কথা। এখানেও দিব্বি দেখা যায়, মায়ের আঁচল ধরে থাকা ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। তারা ভয়ে ভয়ে তাকায় রক্তমাখা অসুর সিংহের দ্বৈরথের দিকে। কিছুক্ষণ পরে ভয় কেটে গিয়ে দৌড় লাগায় সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে। সারি সারি চেয়ারের নিচে দিয়ে কুচোকাঁচাদের হামাগুড়ি দেওয়া লুকোচুরি খেলার গন্ধ প্রয়াসের আঙিনায়ও ভেসে আসে। চিরকালীন হয়ে ওঠে প্রয়াস নিজগুণে।
খিচুড়ির প্লেট নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার গন্ধ। বিজয়ার দিনে মা দুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার গন্ধ। মাইকে ভাসা বীরেন ভদ্রের চন্ডীপাঠের গন্ধ ভরে থাকে পুজোবাড়ির আনাচে কানাচে। বদলেছে প্রবাসীর জীবন। নতুন নতুন অনেক বাঙালি এসেছে, পুরনো বন্ধুদের অনেকেই চলে গেছে নতুন দেশে। টেমসের জলে সন্ধ্যায় পড়েছে শুক্লাষ্টমীর আধো আধো চাঁদের ছায়া। কতপুজোর কৌলীন্য হারিয়েছে, আবার কত পুজো নতুন করে গড়ে উঠেছে। কোথাও রবীন্দ্রনাথ কোথাও রামকৃষ্ণ কোথাও বা শ্রীচৈতন্যর প্রাধান্য, একচ্ছত্র রাজত্ব কিন্তু বাঙালিরই। সন্ধিপুজোয় আজও জ্বলে একশো আট প্রদীপ, দশভূজার দশ হাতে প্রহরণ ঝলসে ওঠে নিয়নের আলোয়। আগমনী আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারে চিরমেঘলা লন্ডনে, কাশ ফুল মাথা দুলিয়ে বলে মা দুর্গা এখানেও আসছেন, মন খারাপ কোরোনা। পঞ্চপ্রদীপের শিখায় মুঠো করা হাত আজও খুঁজে বেড়ায় ছোট্ট ছোট্ট মাথাদের। অঞ্জলির ডাকে সবসময় একটা হুমকি এটাই শেষবার। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে হা ক্লান্ত বাঙালিরা কাঁচুমাচু মুখে আবার যখন পুরোহিতকে অনুরোধ করে, তিনি কি আর ফেলতে পারেন? সেই মন্ত্র গমগম করে প্রতিধ্বনি , ‘নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুন্ডে মুন্ডমালিনি৷ আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোস্তুতে’৷ চামুন্ডা নয় মৃন্ময়ী মায়ের মুখে দেখতে পাই বিশ্বজননীর আদল, আমরা সকলেই মেয়ে আমরা সকলেই মা। সব মেয়েই যেন সম্মান পায় মা, সমাজ আজ বড় বিভাজিত। সবাইকে যেন তার প্রাপ্য সম্মান আমরা দিতে পারি। টেমসের শীতল জলে সেই কাঁদন ভরা হাসিরই আবেশ এই শরতে, অকালবোধনে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।