অরপিংটনের প্রতিমা এসেছে কুমোরটুলি থেকে।
ছোট্ট জনপদ অরপিংটন। আরও ছোট্ট তার বাঙালি সমাজ। কিন্তু, উৎসাহের কিছু কমতি নেই।
জীবনবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন থেকে বৃটেনের দক্ষিনপন্থী পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজের জন্মভূমি। প্রতি বছর নতুন নতুন পরিবারের গন্তব্য হয়ে ওঠে বিখ্যাত স্কুলের জন্য। শহর লন্ডনের উপকণ্ঠে সবুজে সবুজে ঘেরা এই ইংলিশ টাউনেই যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটে গেল। মাত্র সাতটি পরিবার মিলে আয়োজন করে ফেললেন বাঙালির সেরা উৎসবের— দুর্গাপুজো। প্রচেষ্টাটির নাম হল উৎসব। উৎসব নামটিও সার্থক, আক্ষরিক অর্থেই এক টুকরো বাংলাকে তুলে ধরার দারুণ প্রচেষ্টা। সপ্তাহান্তে তিন দিন বাঙালিরা মিলে মেতে উঠবে সর্বজনীন দুর্গোৎসবে।
এ বার ডেস্টিনেশন অরপিংটন। কুমোরটুলি থেকে মা দুগগা ভিসা পাসপোর্টের চক্কর পার করে এসেছেন। ক্রফটন হলে বসবে আনন্দের মেলা। কলকাতার উৎসব এসে হাজির এমন এক হলঘরে। সাহিত্য, কবিতা, খাওয়াদাওয়া, গানবাজনায় বাঙালির সংষ্কৃতি হাত ধরবে পরের প্রজন্মের। যাঁরা হয়তো সে রকম ভাবে কলকাতার পুজোর সঙ্গে পরিচিতই নয়। তবু এ যেন তাদের নিজের পুজো। চিরবহমান সংষ্কৃতি যুগোপযোগী হয়ে বদলে গিয়েও বদলায় না। কারণ বাংলা আর বাঙালিকে না ভালবেসে প্রবাসীর আর উপায় কি?
এগিয়ে এসেছে বহুজাতিক কিছু সংস্থা তাদের আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এই শুভ প্রচেষ্টাকে, পূজাবার্ষিকীতে থাকবে কবিতা গান গল্প। কচি কচি পায়ে বোল উঠবে বাংলা নাচের, গানের হিল্লোলে অরপিংটনের নীল আকাশ ছেয়ে যাবে। নারীর অঙ্গে অঙ্গে ঘুরবে সব্যসাচী, শর্বরী দত্ত, ঋতুকুমার, সোনার ভরি আকাশ ছুঁয়ে যাক না যাক এনআরআই গয়নাময়ীরা ঝমঝমিয়ে ঝলসে দেবেন। গুচি আর্মানি পরিহিত বংপুঙ্গব পোর্শে কিম্বা বিএমডাব্লিউ অথবা মার্সিডিজ চড়ে নামবেন অঞ্জলি দিতে।
আরও পড়ুন: সাইবার সিটির শারদ-সরোদ
চেনা দৃশ্য চেনা মুখ চেনা কথকতা— টিপটিপ বৃষ্টি— তবু নতুন করে জাগবে আবার অরপিংটন উৎসব! কারও ছেলের বিয়ে হচ্ছে নাকি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে, দু’জনেই পড়ত বুঝি একসঙ্গে, সেই নিয়ে জব্বর আলোচনা! কে বা কারা গ্রামার স্কুলের অ্যাডমিশন পেল, কে বা কারা কোন ইউনিভারসিটিতে কি যেন পড়তে গেল সে সব নিয়ে চিরকালীন কথা চলতে থাকবে। অনেকগুলো কচিকুচিরা ইলাস্টিকের ধুতি,শাড়ি পরে তিরতির করে দৌড়োবে পুজোবাড়ির এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। মাইকে বাজতে থাকবেন বীরেনবাবু! বাঙালি যত দিন থাকবেন তত দিন থাকবেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। দেশ বিদেশ সর্বত্র। সিঁদুররাঙা মেঘ দূরে উড়ে যাবে বঙ্গোপসাগরের তীরে আমাদের জন্মভূমির দিকে। মেঘপিওনের ব্যাগে একটুকরো চিঠিতে লেখা রয়েছে অরপিংটনের বাঙালির মনের বার্তা— ভাল থেকো সকলে। সর্বেহত্র সুখিনাঃ সন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া... আমার বাংলা নিরোগ হোক, সুখী হোক শান্তি আসুক আনন্দময়ীর আগমনে।
দেখতে দেখতে কেটে যাবে পুজোবাসর। লালপেড়ে সিল্কের শাড়ি পরবে বাংলার বধূরা। রাজরানির মতো লাগবে সকলকে, তাদের ঘিরে সকলের মুগ্ধতা শুক্লা সপ্তমীর চাঁদের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। মহিলামহল মত্ত থাকুক ফেসবুক থেকে জারদৌসি, হিরে থেকে জিরের আলোচনায়। আমি এগিয়ে যাব মানুষের ভিড়ে। পুজোহলের চার পাশে রিয়্যাল এস্টেটের স্টল, পিঠেপুলি, এগরোল, চাউমিন, শাড়ি, গয়না, বই, ট্যাবলয়েড, কী ভাবে দেশে টাকাপাঠানো যায় এ সবের আড়ালে হঠাৎ নজর পড়বে গড়িয়াহাটের, বালিগঞ্জ অথবা মহম্মদদ আলি পার্কের এক টুকরো রাস্তাঘাট। ফেসবুকের স্ক্রিনে। কলকাতার মানুষের কৌতূহলী নজর অরপিংটন লাইভে ঠিক তেমনই এখানকার মানুষও নজর রাখবে বাগবাজার সর্বজনীন বা একডালিয়ার পুজোর দিকে। এখানের পুজোয় সর্বেসর্বা শুধু নারীরাই। নারী হল সব শক্তির আধার। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও তারা কি ঠিকঠাক সম্মান পাচ্ছে? আমাদের প্রিয় কলকাতাতে হানাহানি আর দুর্ঘটনার কলকাতার ক’টা দিন জাদুবলে মধুর হয়ে উঠেছে যেন।
তেমনই এখানেও আনন্দযজ্ঞে হাজির হয়েছে ইংল্যান্ডের এই শান্তিনিকেতনটি। অঞ্জলির মন্ত্রে— মাকে মনে পড়ে যাবে! ফুলের সাজিতে হাত ছুঁয়ে ধরতে চেষ্টা করি জননীকে, জন্মভূমিকে! সন্ধিপুজো, কুমারী পুজো সব হয় একে একে— নিখুঁত ভাবে, নিয়ম মেনে!
আরও পড়ুন: দেশের স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়াটাই হইচই-এর মূল থিম
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল আমরা প্রথম প্রজন্মের বাঙালিরা বেখেয়ালি বর্ষা, প্যান্ডেলের এলোমেলো বাঁশ, মহালয়ার গান, ধুনুচির আলো— টিমটিমে প্রদীপ সাজিয়ে বসে থাকি— আকাশ জুড়ে ভাসে তুলোমেঘ! পুজো আসে, পুজো যায়! এক দিকে রবীন পাল দুগগার চোখে আলো দেয় লম্ফের আলোতে, অন্য দিকে আমাদের মায়েদের চোখের আলো কমতে থাকে। আমি শিউলি ফুল খুঁজে বেড়াই একা একা একদম একা!
তবু এ শহরই জানে আমার, আমাদের সব কিছুই! সিঁদুরখেলার বরণডালা ছুঁয়ে যাই সবাইকে! সিঁদুর মাখাই আমি সখীদের। একে অন্যকে এ ভাবে একটু করে প্রাণ মিশিয়ে বরণ করে নিই বাংলা সংষ্কৃতিকে। সবাই একে একে বলে যায় শুভ বিজয়া নানা ভাবে নিজেরা নিজেদের মতো করে ভেসে যাই! টেমসের জোয়ারে গঙ্গাও মিশে যায়। দক্ষিণ লন্ডনের অরপিংটনে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঁকি দেয় ঝাঁক ঝাঁক কাশফুলের আড়ালে। হিমের পরশ এখন লেগেছে হাওয়ায়, পূজো শেষ মানেই ঝুপ করে শীত এসে যাবার ভয়ে চাঁদ ও বুঝি চাদর খোঁজে, মেঘের চাদরে ঢেকে যায় শীতকাতুরে নবমী নিশি।
ছবি: পুজো উদ্যোক্তাদের সৌজন্যে।