Halloween Special

ভূত, পেত্নি, ডাইনির যেন সহবাস, ড্রাকুলার রাজত্বে গোটা রাত যা ঘটল! লিখলেন ইংল্যান্ডের বাঙালি

হ্যালোইন উপলক্ষে প্রতি বছর হুইটবি সেজে ঝলমলে হয়ে ওঠে। বিশ্বের নানা দেশের রকমারি ভূত, প্রেত, ডাইনি আর ড্রাকুলাদের বিচরণভূমি তখন।

Advertisement

পৌলোমী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ২০:২৮
Share:

ছবি: সংগৃহীত

১৮৯০ সাল, জুলাইয়ের শেষ দিক। বাক্সপেটরা গুছিয়ে এক আইরিশ ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন মিসেস ভিজির গেস্ট হাউজে। ঠিকানা, ছয় নম্বর রয়্যাল ক্রেসেন্ট, হুইটবি, ইংল্যান্ড। অভিনেতা হেনরি আরভিংয়ের বিজ়নেস ম্যানেজার হিসেবে স্কটল্যান্ডের এক দুরন্ত নাট্য সফরের শেষে এই জেলে বন্দরে ছুটি কাটাতে এসেছেন ওই আইরিশ ভদ্রলোক। ইনি আবার একটু-আধটু লেখালেখিও করেন।

Advertisement

৮ আগস্ট ‘কফি হাউজ অ্যান্ড অফ দ্য কে’ (কোয়ে) নামে রাস্তাটিতে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলেন পাবলিক লাইব্রেরিতে। বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলেন ১৮২০ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ কনস্যুল উইলকিনসনের বুখারেস্টে (বর্তমানে রুমানিয়ায়) থাকাকালীন অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত বই। উইলকিনসন তাঁর বইতে ১৫০০ শতাব্দীর এক রাজপুত্রের কথা উল্লেখ করেন। মারাত্মক নিষ্ঠুর এই যোদ্ধা তাঁর শত্রু এবং মিত্রদের কাছে ‘ড্রাকুলা’’ নামে পরিচিত ছিলেন। রুমানিয় ভাষায় যার মানে ডেভিল বা শয়তান।

আমাদের পরিচিত এই আইরিশ ভদ্রলোক তখনই পেয়ে গেলেন তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের প্লটটি। যদিও বই প্রকাশের প্রায় ছয় বছরেরও আগে থেকে ভদ্রলোক ট্রানসিলভেনিয়ার ভূপ্রকৃতি ও রীতিনীতি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তবুও ছুটি কাটানোর সময়ে লেখা এই বইটিতে হুইটবির বন্দর, ভাঙাচোরা অ্যাবে, ঝোড়ো বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়া চার্চইয়ার্ড ও সমুদ্রফেরত নির্দোষ পর্যটকদের মুখে মুখে ফেরা মশলাদার গল্পগুলি জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি ভাঙা জাহাজের ভগ্নাবশেষ থেকে প্রাপ্ত নাম ও সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মানুষের ক্ষয়ে যাওয়া কবরে খোদিত নাম পর্যন্ত তিনি তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করলেন। এই আইরিশ ভদ্রলোকের নাম ব্রাম স্টোকার। বিশ্ব বিখ্যাত বেস্টসেলিং উপন্যাস কাউন্ট ড্রাকুলার স্রষ্টা। ইংল্যান্ডের অখ্যাত একটি বন্দর নগরকে অচিরেই বিখ্যাত করে দিলেন তিনি।

Advertisement

হ্যালোইন উপলক্ষে প্রতি বছর হুইটবি সেজে ঝলমলে হয়ে ওঠে। বিশ্বের নানা দেশের রকমারি ভূত, প্রেত, ডাইনি আর ড্রাকুলাদের বিচরণভূমি তখন। আপনি হয়তো বেরিয়েছেন প্রাতঃভ্রমণে। আচমকা কোনও এক সাহেব ভূতের খপ্পরে পড়ে গেলেন। দেখলেন, সাহেব তাঁর কাটা মুণ্ডটি এক হাতে ঝুলিয়ে অন্য হাতটি এগিয়ে দিয়েছেন আপনার সঙ্গে হস্তমর্দন করবেন বলে। অথবা আপনি হয়তো সমুদ্রের ধারে কোনও দোকানে বসে একমনে ফিশ অ্যান্ড চিপস খাচ্ছেন। হঠাৎ অ্যাবের দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন বিখ্যাত হোয়াইট লেডির পেত্নী আপনার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। তখন কেমন লাগবে বলুন তো?

ছবি: সংগৃহীত

এই সব অভিজ্ঞতা লাভ করব আর কাউন্ট ড্রাকুলার সঙ্গে মোলাকাত করব বলে গত বছর চলে গেলাম হুইটবিতে। ‘বেভারলি’ থেকে ‘একলেইমস’ কোচের এক দিনের ট্রিপে। মাত্র আধ ঘণ্টার রাস্তা। বাসের মধ্যে অনেকেই ভূত সেজেছে। আমি সেজেছি ‘কাউন্টেস ড্রাকুলা’। ঠোঁট বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। আমার ছেলে তার চেহারার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সেজেছে আলো জ্বলা কঙ্কাল। যথা সময়ে বাস আমাদের হুইটবিতে নামিয়ে দিল। আকাশের অবস্থা ভাল নয়। ঝোড়ো বাতাস আর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ও প্রচণ্ড ঠান্ডায় দাঁত কপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। সমুদ্রও উত্তাল। এই রকম ভূতুড়ে আবহাওয়া তো ভূতেদের উপযোগী হবেই। সবার আগে চললাম অ্যাবেতে। হ্যালোইন উপলক্ষে সেখানে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ হওয়ার কথা কিন্তু বিধি বাম। ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডবে যথারীতি তা বাতিল হয়ে গেল। তবে নাকের বদলে নরুণের মতো ভূতের গল্পের আসর বসল ভাঙা অ্যাবের ভিতর। সেও প্রায় নয় পাউন্ড বা ৯০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে। মধ্যযুগীয় পোশাকে সজ্জিত হয়ে এক ভদ্রলোক ও আর এক ভদ্রমহিলা এলেন ভূতের গল্প শোনাতে। তখন বৃষ্টি খানিক ধরে এসেছে। আকাশের মুখ ভার। ঝোড়ো বাতাসে বয়ে আসা জলের ছাট ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের। সপ্তম শতাব্দীর ভাঙা অ্যাবের পাথুরে মেঝেতে বসে আমরা ভূতের গল্প শুনতে লাগলাম। সে এক গা ছমছমে অভিজ্ঞতা আর কি!

সেন্ট মেরি চার্চের কবরস্থান

ভয়ের গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, পাশের সেন্ট মেরি চার্চের কবরে শায়িত কাউন্ট ড্রাকুলা এই এল বুঝি। এমনিই চমৎকার পরিবেশনা ছিল যে নিমেষে এক ভয়াল, ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। কত ক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসেছিলাম জানি না। বৃষ্টি থামতে চুপচাপ বেরিয়ে এলাম। বৃষ্টি থামার আনন্দে পথে তখন থিকথিক করছে ভূত, পেত্নী, দত্যিদানোর ভিড়। এক জায়গায় দেখলাম ‘নান’ সিনেমা থেকে বেরিয়ে আসা নান তার সঙ্গের কুকুরটিকেও নান সাজিয়ে এনেছে। দু’একজন ভূত, পেত্নীকে ধরে সেলফিও তুললাম। তারাও বেশ আনন্দ করে পোজ দিল আমাদের পাশে। বেশ খিদে পেয়ে যাওয়ায় ফিশ অ্যান্ড চিপস আর আইসক্রিম খেলাম।

ড্রাকুলা

এই ভাবে হ্যালোইনের দিনটা ড্রাকুলা আর ভূতেদের সঙ্গে কাটিয়ে দেদার মজা করে আবার আমাদের নির্দিষ্ট কোচে ফিরে বাড়ির পথে যাত্রা করলাম। অন্ধকার হয়ে এসেছে। তখন হুইটবি অ্যাবেতে সব ক’টা আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, আধো-আলো আঁধারে অ্যাবের ভাঙা জানলা দিয়ে বিশাল লম্বা এক জন কেউ আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। চাঁদের আলোয় তার রক্তমাখা ধারালো শ্বদন্তখানি যেন ঝিকিয়ে উঠল।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement