সর্বক্ষণ কী এক উত্তেজনা! প্রাণস্পন্দনে কাঁপত আমার শহর। ছবি: অনির্বাণ ঘোষ।
সবের আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, দয়া করে আমার কথায় রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা করবেন না।
আমার চোখে বর্তমানের কলকাতা বহিরঙ্গে ভারী সুন্দরী! সব দিক থেকেই যেন তার শরীরে সৌন্দর্যের ঢল। বদলে অন্তরঙ্গতায় যেন অনেকটাই খামতি। যা আমার কাছে ছেলেবেলার দুর্লভ সম্পদ। আরও একটি বড় বদলে ইদানীং চোখে বিঁধছে। আমার যৌবনে কলকাতাও যৌবনবতী হত রাত গড়ালে। রাত ২টোর আগে ঘুম নামত না তিলোত্তমার চোখে। এখন সত্যিই বয়স বেড়েছে তার। রাত ১০টা বাজলেই কলকাতা যেন নিঝুম পুরী। রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। মাল্টিপ্লেক্স ছাড়া আর কোথাও নাইট শো দেখা যায় না। এত ফাঁকা রাস্তাঘাট মেয়েদের জন্য কতটা সুরক্ষিত? সেই প্রশ্নও কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
বরাবরই কলকাতার আত্মা তার রাজনৈতিক মনস্কতা। সেটা ব্রিটিশ শাসনের সময়েও ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাতে ঘাটতি ছিল না। ইদানীং সেখানেও ভাটার টান। রাজনৈতিক উদ্যম যেন বিলুপ্তপ্রায়। একই সঙ্গে নিভু নিভু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও। ষাট বা সত্তরের দশকে কলকাতা যতটা সংস্কৃতিমনস্ক ছিল, এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন দেখি, কলকাতার মানুষ কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে উন্মত্ততা প্রকাশ করেন। যেমন, রাজনৈতিক নেতাদের কেচ্ছা। কিংবা তারকাদের প্রতি অহেতুক কটাক্ষ। এ নিয়েই সারা ক্ষণ মাতামাতি। এ নিয়েই সবার অকারণ মাথা ব্যথা। আগেকার আড্ডায় ফুটবল, ক্রিকেট, সাহিত্য, রাজনীতি, থিয়েটার, সিনেমা জায়গা করে নিত। কলকাতার আড্ডা বুঝি সে সবও ভুলতে বসেছে? এগুলি ছাড়া শহরটাই যেন আলুনি!
রকের আড্ডা, পাড়া সংস্কৃতি সব সময়েই প্রাণবন্ত। ক্লাব সংস্কৃতি তখনও ছিল। এখনও আছে। ছবি: সংগৃহীত
শহরজুড়ে শুধু বহুতল, আকাশছোঁয়া আবাসন। সেখানে অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছলদের ভিড়। ফলে পাড়া থেকে আড্ডা উঠে বসতি গড়েছে অ্যাপার্টমেন্টে। সেই আড্ডায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা নেই। তাঁরাই এত দিন গান, গল্প, কৌতুকে সজীব রাখতেন সকলকে। সেই আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। সৃষ্টি হয়েছে কত গান, কবিতা, গল্প, নাটক, সিনেমার। সৃষ্টিশীল সেই আড্ডাকেও বড্ড মিস করি আজকাল। পাশাপাশি, কাজের সূত্রে এই প্রজন্ম প্রবাসী। কলকাতা থেকে বহু দূরে। তা হলে আর আড্ডা জমাবে কে? আগামী প্রজন্মের কত জন যে নিজের শহরকে ভালবেসে থেকে যাবে এখানে, তা নিয়ে এক এক সময়ে যথেষ্ট সন্দেহ জাগে।
শহরের এই পরিবর্তনগুলি দেখতে দেখতে প্রায়ই মনের চোখে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার, যৌবনের ফেলে আসা কলকাতা। সর্বক্ষণ কী এক উত্তেজনা! প্রাণস্পন্দনে কাঁপত আমার শহর। রকের আড্ডা, পাড়া সংস্কৃতি সব সময়েই প্রাণবন্ত। ক্লাব সংস্কৃতি তখনও ছিল। এখনও আছে। ফারাক একটাই, তখন রাজনীতি সব কিছুতেই এখনকার মতো নাক গলাত না। ফলে সকলে সহজ ভাবে মেলামেশা করতে পারতেন। এখন বন্ধুত্ব হয় রং দেখে! সেই রং ছড়িয়েছে গোটা শহরে। এক রঙে শহরকে রাঙানো খুব দরকার ছিল? বেশ তো ছিল নানা রঙে রঙিন আমার কলকাতা।
তার পরেও বলব, এই কলকাতাও আমাকে আকৃষ্ট করে। সকলের মতো আমিও যে যৌবনের পূজারি