কলকাতার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আশুতোষ কলেজে পড়ার সূত্রে। আগামীর স্বপ্ন দেখার প্রথম দিনের সাক্ষী বলতেও সেই কলকাতাই।
কলকাতার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আশুতোষ কলেজে পড়ার সূত্রে। বালি থেকে আশুতোষ কলেজে পৌঁছনোর রাস্তাটা বেশ লম্বা। আমার বাড়ির সবচেয়ে কাছের স্টেশনের নাম রাজচন্দ্রপুর। সেখান থেকে ডানকুনি লোকাল ধরে দমদম, দমদম থেকে মেট্রোতে ভবানীপুর। তখন ডানকুনি লোকাল চলত ঘণ্টায় একটি করে। অর্থাৎ একটি ট্রেন না পেলে টানা এক ঘণ্টার অপেক্ষা। প্রতি দিন সকালে ব্যাগ পিঠে ধাক্কাধাক্কি করতে করতেই আমার পরিচয় কলকাতা শহরের সঙ্গে।
মফস্বল বা শহরতলি থেকে কলকাতায় আসার মধ্যে যে যাত্রা, সেটি এক দিক থেকে মনস্তাত্বিকও বটে। তার অনেকখানি জুড়েই ছিল এক ধরনের সঙ্কোচবোধ। এক দিকে ভয় ছিল, এত বড় একটা শহরের, অন্য দিকে ছিল নিজেকে বুঝে ওঠার লড়াই। কলকাতা শহর আমায় মেনে নেবে কি না, বা আমি কলকাতা শহরের মতো হয়ে উঠতে পারব কি না, এই দ্বন্দ্বে কেটেছিল অনেকগুলি দিন। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এই অন্বেষণ আসলে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে নেওয়ার একটা পথ। আমার রাজনীতির প্রথম পাঠ, জেলা কমিটির প্রথম মিটিং, কমরেড সুদীপ্ত গুপ্তর সঙ্গে একই ঘরে বসা সব কিছুই কলকাতায়। প্রথম বার প্রেমে পড়াও এখানেই। কলকাতা ওই তিন বছরেই অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে আমায়, আগামীর স্বপ্ন দেখার প্রথম দিনের সাক্ষী বলতেও সেই কলকাতাই।
তবে আমার কলকাতাবোধ অনেকটাই দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রিক। কলেজ বা কলেজে পড়তে আসা সহপাঠীদের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার উপর পড়েছিল। শহরতলি থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, ছোট থেকে কলকাতায় বেড়ে ওঠা মানুষদের আদবকায়দায় বেশ খানিকটা অন্তর ছিল। অন্তর ছিল পোশাক, বাচনভঙ্গিতেও। আমি বাংলা মাধ্যমের ছাত্রী, আর কলেজে লেখাপড়ার মাধ্যম ইংরেজি। প্রথম কয়েক মাস কেটে গিয়েছিল শুধু হিসেবে ইংরেজি আয়ত্ত করতেই। তবে কলকাতা শহর আপনও করে নিয়েছিল অচিরেই। গড়িয়াহাট, দক্ষিণাপণ কিংবা লেক যে কখন এত কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতেও পারিনি।
বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ আমার মনের খুব কাছের একটি জায়গা ছিল। ভেবেছিলাম গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভর্তি হব সেখানে। তাই কলেজ শেষ হওয়ার আগে থেকেই যাতায়াত ছিল, আলাপ ছিল সিনিয়রদের সঙ্গেও। তবে সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি ছিল বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সবচেয়ে উপরের তলার বড় ক্যান্টিনটি। সেই ক্যান্টিনের জানালায় দাঁড়ালে মনে হত যেন দেখা যাচ্ছে কলকাতার অর্ধেকটা।
বরাবরই খুব ভুলো মন আমার। ব্যাগ, পার্স কিংবা প্র্যাকটিক্যালের খাতা যে কত অজস্রবার আমি এখানে ওখানে ফেলে এসেছি তার ইয়ত্তা নেই। অথচ কোনও দিন কোনও কিছুই হারায়নি। বন্ধুরা ঠিক খুঁজে পেয়ে রেখে দিয়েছে গুছিয়ে। মাঝেমধ্যে ভুলে যেতাম পরীক্ষার তারিখও, ত্রাতা আবারও সেই বন্ধুরাই। কলেজ কেটে ছবি দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও বিস্তর। হই হই করে ‘ডন’ ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা কোনও দিন ভোলার নয়। মনে আছে আমরা প্রায় চল্লিশ জন সহপাঠী একসঙ্গে, একটিই বাসে করে দক্ষিণ কলকাতার একটি মলে গিয়েছিলাম। সবে ফার্স্ট ইয়ার তখন। গোটা বাসের সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আমাদের চিল চিৎকারে। বন্ধুদের জন্মদিন উদযাপন করা হত যতীন দাস পার্কে। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে চলে আসতাম গরিয়াহাট। বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সব কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার অলিগলিতে।
অথচ জীবন এমনই অদ্ভুত, সেই সব গলি, সেই সব মানুষ, সেই সব হাত ছেড়ে দিল্লি চলে যেতে হল এক দিন। নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট কাকে বলে, হয়তো তখনই বুঝতে পারি। প্রথম একটা বছর কেটেছিল অসহনীয় ভাবে। মন কেমন করত সব সময়। কিন্তু সময়ের ধর্মই বোধহয় বদল। সম্পর্ক, জীবনের ধারণা সব কিছুই বদলে গেল একটা সময়। মনে হল দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই। কলকাতা শেষ পর্যন্ত থেকে গেল একটা নিভৃত আরামের বোধ হয়ে। যখন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে ঘুরতাম, যেন হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠত বালিগঞ্জ।
আমার চিরকালই জল খুব ভাল লাগে। বাড়ির থেকে অল্প দূরেই পাতা আছে গঙ্গা। আর গঙ্গার পাড়ে বসে কাটিয়ে দেওয়া অজস্র সন্ধ্যা পাতা আছে বুকে। দক্ষিণ কলকাতায় তবু সরোবর পেয়েছিলাম। দিল্লিতে গিয়ে মিস করতাম এই জলটুকু। যেটুকু জল, তার চেয়ে যেন অনেক বেশি আবিলতা।
সব শেষে বলতে হয় কলকাতা আমার স্বপ্ন দেখার শহর। বিপ্লব আর বিরহ মিলে মিশে আছে সেই স্বপ্নে। কলকাতা মানে আমার বন্ধুত্বের তাগিদ, বাড়ি ফেরার আরাম। কষ্ট হয় যখন কলকাতায় নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দেখি, এত হানাহানি দেখি, রাজনীতির প্রয়োজনে অন্যায়ের পক্ষ নিতে দেখি প্রশাসনকে। যে শহরে বৈচিত্রের বুনন এত নিবিড় তাকে এই হানাহানি মানায় না। বরং অনেক বেশি মানায় রংমিলান্তি। বেঁচে থাকুক আমাদের চায়না টাউন, বেঁচে থাক আমাদের বড়বাজার, আমাদের বনেদি উত্তর কলকাতা, আধুনিক দক্ষিণ কলকাতা। সবাই ভাল থাকুক, একা একা নয় বরং একসঙ্গে। হাতে হাতটুকু রেখে।
(লেখক এসএফআই-এর সর্বভারতীয় নেত্রী)