রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রথম বাঙালি আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীদের বিষয়ে উদার, প্রগতিশীল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখাপত্রে মেয়েদের স্বাধিকার দিয়েছিলেন, কিন্তু জীবনের সকল ক্ষেত্রে কি রক্ষা করতে পেরেছিলেন সে আদর্শ? তথ্য বলছে, না। যখন বিবাহ করলেন কবি তখন কত ছিল তাঁর স্ত্রীর বয়স? নিজের কন্যাদের বিবাহ দিয়েছিলেন কোন বয়সে? কবির ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণের পর বলেন্দ্রনাথের বিধবাপত্নী সাহানা দেবীর বিবাহসম্ভাবনা মেনে নিতে পারেননি কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। সেই বিয়ে আটকানোর জন্যও মহর্ষির দূত রবি। এই প্রসঙ্গগুলি অপ্রিয়, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই পিছুটানগুলিই তো শেষকথা নয়।
তাঁর জীবৎকাল উনিশ আর বিশ এই দুই শতকে প্রায় আধাআধি ভাবে বিভক্ত। উনিশ শতকে পশ্চিমের হাতফেরতা আধুনিকতার স্পর্শে বাঙালির অন্দরের ছবি বদলে যাচ্ছিল। ঠাকুর বাড়িতে সেই বদলের হাওয়া এসে লাগছিল। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রথম বাঙালি আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীদের বিষয়ে উদার, প্রগতিশীল। সত্যেন্দ্রনাথ মনে করতেন, ‘স্ত্রীদের উন্নতিতে জাতীয় উন্নতি, স্ত্রীদের অবনতিতে জাতির দুর্গতি।’ বাঙালি মেয়েদের অবরোধ প্রথা তাঁকে বেদনা দিত। লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালাদেশে নারীবর্জিত জনতা কেমন অপ্রিয়দর্শন।’ নিজের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে সত্যেন্দ্রনাথ ঘরের বাইরে এনেছিলেন। বাল্যবিবাহের তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী, বিধবা বিবাহের পক্ষপাতী। মনে করতেন, ‘বিবাহ-বিষয়ে স্ত্রী-পুরুষের স্বাধীন অধিকার সমান থাকা উচিত।’ সত্যেন্দ্রনাথের মেয়েদের বিষয়ে এই উদারতা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের চরিত্র বদলে সহায়তা করেছিল সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনে কিছু পিছুটানের পরিচয় দিলেও মনে মনে যে নারীর মুক্তিতে কিশোরবেলা থেকেই বিশ্বাসী লেখাপত্রে তার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কম বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘বনফুল’ নামে যে কাহিনি-কাব্য লিখেছিলেন তাতে ছিল, ‘বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না--/ তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে!’ সামাজিক বিবাহবিধির চাইতে পাত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছে যে বড়ো এ কথাই রয়েছে এ-রচনায়। বাস্তবে বিবাহিত জীবনে উনিশ শতকে পুরুষদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেই মুখ্য হয়ে উঠত অধিকাংশ ক্ষেত্রে। পুরুষদের যৌন চাহিদা পূর্ণ করাই যেন বিবাহিত স্ত্রীদের ঐকান্তিক কর্তব্য। বিছানায় যেতে না-চাইলে নাবালিকা স্ত্রীদের মারতে বাঙালি পুরুষেরা পিছপা হতেন না। ১৮৭৩-এর এডুকেশন গেজেটে, ১৮৭৫-এর ঢাকা প্রকাশে এমন বউ-পেটানোর খবর চোখে পড়বে। ১৮৯০ সালে পঁয়ত্রিশ বছরের হরি মাইতি তাঁর দশ কি বারো বছরের নাবালিকা স্ত্রী ফুলমণিকে হত্যা করলেন– দাম্পত্য ধর্ষণের ফলে ফুলমণির মৃত্যু হল। রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘নারীর উক্তি’ কবিতায় মেয়েটি তার স্বামীকে বলেছে, ‘অপবিত্র ও করপরশ/ সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে।’ বহুগামিত্ব, দাম্পত্য-ধর্ষণ এ-সবই পুরুষের হৃদয়হীন স্পর্শ। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মেয়েটি তার বিরোধিতা করছে।
আরও পড়ুন: বাধার পাহাড় পেরনোর কাহিনি লিখছে চম্পারণ
নারী পুরুষের সামাজিক বৈষম্য সমাজের বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যেই প্রকট রবীন্দ্রনাথ এ কথা বিশ্বাস করতেন। বাইরে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার পুরুষ, ঘরে সেই পুরুষই নারীর অধিকর্তা। জমিদারের কোরফা প্রজা- ছিদাম দুখীরাম রুই, জমিদার তাদের বঞ্চনা করে। বাড়ি ফিরে তারা স্ত্রীদের গঞ্জনা দেয়– স্ত্রীহত্যার দায় বাড়ির বউয়ের ওপর চাপে। রুইদের বাড়িতেই শুধু নয় দরিদ্র উচ্চবর্ণের মেয়েদেরও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে মরে যেতে হয়। নিরুপমার বাবা পণের টাকা দিতে পারেননি বলে নিরুপমাকে মরে যেতে হল। বোবা মেয়ে সুভারই বা কী গভীর দুঃখ! দেনা-পাওনার এই জগতে মেয়েদের মূক হয়ে সইতে হচ্ছে সব– রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটো গল্পে সেই সব লিখে রাখছেন। লিখতে লিখতে ব্যক্তিগত জীবনের পিছুটান থেকে মুক্তিও পাচ্ছেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ১৯০৫-এ মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে পিছুটান কিছু কমল, সাহানা দেবীর বিবাহ আটকাবার জন্য তাঁকে মহর্ষির দূত হতে হয়েছিল, এবার প্রকাশ্যে বিধবা বিবাহ সম্পাদনে আর অসুবিধে রইল না। উনিশ শতকে বিধবাদের ওপরে যৌনবিশুদ্ধির যে আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা যে কতটা অযৌক্তিক তা কাণ্ডজ্ঞান-সম্পন্ন বিদ্যাসাগর খুবই জানতেন। বিদ্যাসাগরের সংগত প্রশ্ন, ‘তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়… দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত… নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক।’ রবীন্দ্রনাথ পরে বিদ্যাসাগর চরিতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখবেন, বিদ্যাসাগর বিধবাদের ‘অচেতন নিষ্ঠুরতা’ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: নারী দিবস ঘিরে বিতর্ক, দুই শিবিরে ভাগ সোশ্যাল মিডিয়া
অচেতন নিষ্ঠুরতা থেকে মেয়েদের কীভাবে মুক্তি দেওয়া যায় এই ছিল বিশ-শতকে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম অনুসন্ধানের বিষয়। মুক্তি মেয়েদের নিজেদের অর্জন করতে হবে এ তিনি বুঝতেন। পুরুষতন্ত্রের দাপট তো কেবল পারিবারিক পুরুষদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, পারিবারিক দাসত্বতন্ত্র বজায় রাখার কাজে মাতৃস্থানীয়াদের বিশেষ ভূমিকা। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা মাতৃস্থানীয়াদের কথায় উঠবে বসবে কেন? ললিতা আর সুচরিতা এই চরিত্রদুটি মাতৃস্থানীয়াদের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে অস্বীকার করেছে। ‘গোরা’ উপন্যাস লেখার সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ পরিবার-সমাজ-দেশ এই তিনকে চরিত্রগুলির বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছিলেন। অনেক সময় পরিবার-সমাজ-দেশের নামে মেয়েদের নেশাগ্রস্ত করে ভুলিয়ে রেখে তাদের অচেতন নিষ্ঠুরতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয় এ তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন। এ কৌশল স্থূল পুরুষতন্ত্রের থেকে অনেক সূক্ষ্ম। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বিপ্লবী সন্দীপ দেশের নামে বিমলাকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছিল, সেই ভুলিয়ে রাখা মেয়েদের অচেতন করে রাখা। যদি বিপ্লবের কাজে মেয়েদের যোগ দিতেই হয় তাহলে মেয়েদের সচেতন ভাবে নিজে বুঝে তাতে অংশগ্রহণ করতে হবে। ‘রক্তকরবী’ নাটকে খনিশহরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি মেয়েই বিদ্রোহের প্রেরণা দেয়, নিজে যোগ দেয় সেই লড়াইয়ে। ভারতীয় রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ তখন শুরু হয়েছে। লড়াই তো কেবল বাইরে করলে হবে না, ঘরেও করা চাই। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল ইংরেজি জানে না, বাংলায় কবিতা লেখে। মীরাবাঈয়ের কাহিনি সে পরম্পরায় জানে। সেই পরম্পরার সূত্রে সে বুঝেছে মীরা, ভারতীয় মীরা, স্বামীর শাসনকে অগ্রাহ্য করেছিল। মৃণালও পারে। তার স্বামী যে তাকে প্রহার করেছিল তা তো নয়– মৃণালের সংবেদনের জগৎ আরও সূক্ষ্ম। সে বুঝতে পেরেছিল শ্বশুর বাড়িতে, স্বামীগৃহে তার কথার কোনও দাম নেই। তাই সে কলকাতার গলি ছেড়ে, স্বামীর গৃহ ছেড়ে চলে গেল। স্বামীর চরণতলের আশ্রয়কে এই নতুন কালের ইংরেজি না-জানা মেয়ে তার পরম্পরার সূত্রে অস্বীকার করতে পারল। ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের মৃণালকে মেনে নিতে পারেননি, তবে রবীন্দ্রনাথ, কী ঘরে কী বাইরে, মেয়েদের নিজেদের মুক্তি খোঁজার পরিসরটুকুকে অকপটে স্বীকার করছিলেন। বুঝতে পারছিলেন কাজটা খুবই কঠিন– একধাক্কায় হবার নয়। কতবার যে এগোতে পেছোতে হবে। মৃণালের ঘর ছাড়ার গল্প তো কত আগে লেখা, ‘যোগাযোগ’ অনেক পরের উপন্যাস। বিপ্রদাস তার বোন কুমুদিনীকে ভাইয়ের মতোই মানুষ করেছিল। তবু সেই কুমুদিনী তার স্বামী উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন ঘোষালের দাম্পত্য-ধর্ষণের মার সয়েছে– মৃণালের মতো দৃঢ়তা কুমুর নেই। দাম্পত্য ধর্ষণের ফলে যে সন্তান তার গর্ভে এসেছে তাকে নিয়ে কুমু দাদার ঘরে চলে গিয়েও আবার স্বামীগৃহে ফিরেছে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সে সময় সন্তান-সহ মায়ের ডিভোর্স-এর কাহিনি বা সিঙ্গল-মাদারের কাহিনি লেখা অসম্ভব। জন্মনিয়ন্ত্রণের নানা উপায়ের ব্যবহারও সে-সময় ছিল না, এখনই বা সে উপায়গুলি ভারতবর্ষের কতজন নারী ব্যবহার করেন?
মেয়েদের অধিকার মেয়েদের আদায় করে নিতে হবে। অধিকার বলতে কেবল শিক্ষা বা বিধবা-বিবাহের আইনি অধিকার নয়, দাম্পত্যযাপনে অস্তিত্ব ও মর্যাদারক্ষার জন্য মেয়েদের পেতে হবে আরও গভীরতর অধিকার এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ছিল। মেয়েদের এই নতুন করে গড়ে ওঠার পাশাপাশি পুরুষদেরও নতুন করে নিজেদের গড়ে নেওয়া চাই। আধিপত্য বিস্তারের ও পৌরুষের দাপট দেখানোর বাইরে আসুন তাঁরা। নিখিলেশ সন্দীপমুখী বিমলার ওপর বলপ্রয়োগ করেনি। কুমুদিনীর দাদা বিপ্রদাস– বিপ্রদাসের মধ্যে কুমু খুঁজে পেয়েছিল অন্যরকম এক পুরুষকে। আরও উদাহরণ দেওয়া সম্ভব রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে।
১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ। দেশ তখনও পরাধীন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছেন এমন নয়। মেয়েদের শরীর ও মনকে নানা অছিলায় নানা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পুরুষতন্ত্র। মেয়েদের সম্বন্ধে আপাত ঔদার্যের কথা বলেন এমন পুরুষও কিন্তু নিজেদের প্রাত্যহিক কাজে-কর্মে নিজের ভেতরের পুরুষকে পরিশীলিত করতে অক্ষম। নারীদের যেমন নিজেদের অধিকারের কথা বলতে হবে তেমনই পুরুষদেরও নিজেদের বদল করতে হবে, ভেতর থেকে। একথাটাই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে ও লিখতে চেয়েছিলেন, নিজের সামাজিক-পারিবারিক পিছুটান থেকে বাইরে আসতে চেয়েছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy