নেতাজি এক্সপ্রেসে নির্ধারিত ওজনের থেকে ১৩৪ শতাংশ বেশি পণ্য পরিবহণ! নিয়ম ভঙ্গ করায় ব্যবসায়ীকে ন’লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে বলেছিল রেল। সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চাইল না কলকাতা হাই কোর্টও। বিচারপতির নির্দেশ, ওই ব্যবসায়ীকে জরিমানা দিতেই হবে।
ঘটনাটি ২০২৩ সালের। হাওড়া থেকে কালকা পর্যন্ত চলা নেতাজি এক্সপ্রেসের (পূর্বতন কালকা মেল) পার্সেল বগির একটি অংশ দু’বছরের জন্য লিজ়ে নিয়েছিলেন মহম্মদ সাবির নামে এক ব্যবসায়ী। চুক্তি মোতাবেক, ওই ট্রেনে তিনি ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে যেতে পারবেন। ব্যবসায়ীকে যাত্রাপ্রতি দিতে হবে ৪২,৩০০ টাকা। যাত্রিবাহী এক্সপ্রেস ট্রেনের নিয়ম অনুযায়ী, পার্সেল ভ্যানে সর্বাধিক ৪ মেট্রিক টন (৪০০০ কেজি) পণ্য বহন করা যাবে। অতিরিক্ত ওজন পাওয়া গেলে ব্যবসায়ীকে জরিমানা দিতে হবে। ২০২৩ সালের ১০ অগস্ট রাত ১০টা নাগাদ হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ে। রেলের দাবি, সন্দেহ হওয়ায় পরের দিন চালক পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে পণ্য ওজন করান। তখন দেখা যায় নির্ধারিত ওজনের থেকে দ্বিগুণের বেশি পণ্য ছিল ওই বগিতে। ওজন করে ৮৩৪৪ কেজি পণ্য পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ওজন ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তার পরে আবার যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি।
জানা গিয়েছে, সে দিন ওই ট্রেনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। নির্দিষ্ট গতিবেগে ট্রেন চালানো হলেও বার বার গতি কমে যাচ্ছিল। পর দিন সকালে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড় করিয়ে দেন চালক। শুরু হয় ট্রেন পরীক্ষার কাজ। শেষমেশ ধরা প়ড়ে বিষয়টি। অবশেষে অর্ধেক পণ্য নামিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে ট্রেন। অতিরিক্ত পণ্য বোঝাইয়ের কারণে সেই ব্যবসায়ীকে ন’লক্ষ টাকা জরিমানা করেন রেল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সাবির হাই কোর্টে যান। অসন্তুষ্ট হয় উচ্চ আদালতও। মঙ্গলবার বিচারপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় রায় ঘোষণা করে জানান, রেলের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করা হবে না। জরিমানা দিতে হবে ব্যবসায়ীকে।
ওই পণ্যগুলি ছিল ট্রেনের সামনের দিকে। রেলের ভাষায় যা ‘ফার্স্ট সিটিং কাম লাগেজ রেক’ বলা হয়। রেলের বক্তব্য, চালক ট্রেন চালাতে সমস্যার কথা জানান। ফলে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশনে ট্রেন দাঁড় করাতে বলা হয়। তদন্ত করে ট্রেন পরীক্ষক জানান, ইঞ্জিন এবং পার্সেল কোচের মাঝে ‘বাফার হাইট’-এর তারতম্য রয়েছে। যা বিপজ্জনক হিসাবে ধরা হয়। তারা জানায়, ব্যবসায়ীর ওই অবৈধ কাজ যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে। তাই কোচ খুলে ওজন কমাতে হয়। ট্রেন ২ ঘণ্টা দেরিতে চলে। ঘটনার জেরে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে রেল। জরিমানাও করা হয়। রেলের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যান ব্যবসায়ী। তাঁর বক্তব্য, ওজন করার সময় তিনি বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। যা নিয়মবিরুদ্ধ। তা ছাড়া রেলের আইন অনুযায়ী, এই ধরনের একই অপরাধ তিন বার হলে তবেই শাস্তি দেওয়া যায়। ব্যবসায়ী জানান, ওই ঘটনায় রেল জরিমানা, চুক্তি বাতিল এবং জামানত বাজেয়াপ্ত করে। একই অপরাধে তিনটি শাস্তি কেন? আদালতে তাঁর আবেদন, চুক্তি পুনর্বহাল এবং সমস্ত টাকা ফেরত দেওয়া হোক।
পাল্টা রেল আদালতে জানায়, ওজন করার সময় পার্সেল স্টাফ, চিফ লোকো ইন্সপেক্টর, আরপিএফ ও অন্য আধিকারিকেরা ছিলেন। অতিরিক্ত ওজনের ফলে ট্রেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ওই ঘটনা যাত্রীনিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করেছে। ট্রেন চলাচলে দীর্ঘ ক্ষণ বিলম্ব হয়েছে। শর্ত মোতাবেক চুক্তি বাতিল করেছে রেল। হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, দ্বিগুণের বেশি অতিরিক্ত ওজন কোনও ভাবেই ছোটখাটো ভুল নয়। এটা গুরুতর অভিযোগ। ট্রেন গতি অনিয়ন্ত্রিত হলে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এমন অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে রেল পদক্ষেপ করতেই পারে। আদালতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা, যাত্রীনিরাপত্তার সঙ্গে কোনও ভাবেই আপস করা যায় না। শর্ত লঙ্ঘন করলে আইন মেনে রেল কঠোর ব্যবস্থা নেবে। ওই ঘটনায় রেল প্রশাসনের সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতার নজির পাওয়া গিয়েছে। হাই কোর্টের রায়, রেলের আইন মেনে পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত ওজন থাকলে ব্যবসায়ীকে তিন বার সুযোগ দেওয়া হত। এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণের বেশি ওজন ছিল। তাই আদালত মনে করছে রেল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যথার্থ। খারিজ হয়েছে ব্যবসায়ীর আবেদন।