নিজেদের অধিকারের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসছেন ওঁরা। —নিজস্ব চিত্র।
তাঁদের কথা না ভাবলে এ বার থেকে সব ভোট পড়বে ‘নোটা’-তেই। সাফ উড়ে এল উত্তর!
ভোট আসে ঘুরে ঘুরে। তৈরি হয় নির্বাচনী ইস্তেহার। কারও সমস্যা উঠে আসে তাতে, কেউ বা পান অন্য কোনও প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তাঁরা থেকে যান ব্রাত্যই। রাজনৈতিক নেতারা আসেন ওঁদের পাড়াতেও। ভোট প্রার্থনা করেন। আলাপ হয়। সমস্যা-সঙ্কট নিয়ে হয় আলোচনাও। তবু কোনও দলের পরিকল্পনা-প্রতিশ্রুতিতে জায়গা হয় না ওঁদের ভাল-মন্দের।
তাও ভোট দেন ওঁরা বছর বছর। কীসের আশায়? এ প্রশ্নে এখন আর মন খারাপ হয় না উত্তর কলকাতার যৌনপল্লির মহিলাদের। মুখ লুকিয়ে, দুঃখ পেয়ে দিনযাপন করার বিলাসিতার সময় যে নেই, তা ভুলতে চান না ওঁরা। জানেন, নিজেদের কথা তুলে ধরতে হবে নিজেদেরই। আর তো কেউ বলে না। ভাবেও না। সোনাগাছি চত্বরের সরু গলিতে দাঁড়িয়ে বৈশাখের গনগনে দুপুরে কোহিনূর বেগম তপ্ত স্বরে বলতে পারেন এখন, শ্রমিকের সম্মান চান তাঁরা। গত ছাব্বিশ বছর ধরে তিনি রয়েছেন এই পেশায়। তার জন্য যে দল লড়বে, ওঁরা তাদেরই পাশে। গলা মেলান ডলি সাহা, অবেদা বিবিও। জানান, সামাজিক সম্মান চাই। সে জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে লড়ছেন ওঁরা। তবু যেন কিছুই এগোয় না। আবেদা বলেন, ‘‘আমরা কেউ অপরাধী নই। কারও ক্ষতি করি না। ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীরা যেমন এক-এক জন এক-এক রকমের পরিষেবা দেন, আমরাও তেমনই দিয়ে থাকি। আমরা শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করি। তবে যৌনকর্মীদের কেন অপরাধীর তকমা দেওয়া হয়?’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এ বার তাই রুখে দাঁড়াতে চান তাঁরা। জানান, এ ভাবে চলতে থাকলে আর মেনে নেওয়া হবে না। এখানে কেউ আর অসম্মানের ভয়ে মুখ বুজে থাকতে রাজি নন। তাতে যে কোনও লাভ হয় না, তা দেখা হয়েছে যথেষ্টই। বহু বছর ধরে সমাজের রক্ষক থেকে সমাজবিরোধী, নানা তরফের অত্যাচার সয়ে চলেছেন ওঁরা। এমনই সব অভিযোগ উঠে আসে যৌনপল্লির বলিষ্ঠ সব কণ্ঠে।
‘‘যৌনকর্মীদের কথা ভাবেন না কেউ, তাই ভোট যাবে নোটা-য়’’—জোর গলায় উড়ে এল চামেলি সাহার বক্তব্য। গত আট বছর ধরে এ পাড়ায় কাজের জন্য আসছেন তিনি। বাড়ি থেকে সকালে সঙ্গে করে নিয়ে বেরোন নিজের মেয়েকেও। কলকাতার স্কুলেই পড়ে সে। স্কুল থেকে ফিরে কিছু ক্ষণ জিরিয়ে ফের টিউশন। সন্ধ্যাবেলা মায়ের সঙ্গেই বাড়ি ফেরে ন’বছরের সেই বালিকা। চামেলির মেয়ের কথা উঠতেই কথা ঘোরে পরিবারের দেখভালের বিষয়ে। ডলি তোলেন প্রসঙ্গটা। বলে চলেন, ‘‘আইনের অনেক বাধা আছে। সন্তানদের আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে আর আমাদের টাকায় খাওয়া-পরার নিয়ম নেই। এমন চলতে পারে নাকি?’’ বছর বাইশের ছেলে তাঁর। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কে নেবে তাঁর পড়াশোনার দায়িত্ব, যদি মা না দেখেন? সঙ্গে গলা চড়ান অন্য মায়েরাও। কীসের জন্য দিনরাত খেটে কাজ করছেন, যদি ছেলেমেয়ে, বাবা-মায়ের দেখাশোনাও না করতে পারেন নিজেদের রোজগারের টাকায়? অথচ আইন বলে, ওঁদের রোজগারের টাকা নিতে পারবেন না কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আলোচনায় তপ্ত দুপুর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আরও। মন খারাপ করেন না ওঁরা। বরং রাগ বেরিয়ে আসে।
সেই রাগটা স্পষ্ট ভাবে পৌঁছে দিতে চান রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাছেও। যদি তাঁরা অপরাধীই হন, তবে তাঁদের ভোটের প্রয়োজনই বা কী কোনও প্রার্থী
কিংবা দলের? প্রশ্ন তোলেন কোহিনূরেরা। ঘুরেফিরে আসে চামেলির সেই কথা, এর পর থেকে সোনাগাছির হাজার দশেক যৌনকর্মী ও তাঁদের পরিবারের ভোট পড়বে নোটা-তেই। কারণ, যে দল ওঁদের কথা বলার দায়িত্ব নেবে না, তাদের ভোট দেওয়ার দায়িত্বও নেই ওঁদের। যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সম্পাদক কাজল বসু বলেন, ‘‘আমাদের সাত দফা দাবি রয়েছে। শ্রমিকের অধিকার চাই আমরা। আমরা কেন আলাদা করে আইটিপিএ আইনের আওতায় পড়ি? বাকি কোনও পেশার মানুষের উপরে তো আলাদা আইন চাপানো হয় না। এ তো হাতে না মেরে যেন ভাতে মারা!’’
সেই ভাতে মারার রাজনীতি আর মেনে নেওয়া নয়। স্পষ্ট কথা ওঁদের। মনে করিয়ে দেন স্পষ্ট ভাষায়, সম্মান দিলে তবেই সম্মান পাওয়া যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy