Advertisement
১১ জুন ২০২৪
Education

Education: ‘আঁধারে আলো’ স্বেচ্ছাশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ

বেলপাহাড়ির করাতশোল গ্রামের পড়া-ছুট এই সব ছেলেমেয়েদের কাছেই মুশকিল আসান হয়ে উঠেছেন গ্রামের দুই যুবক বিপ্লব শ্যামলী ও নয়ন সিং।

করাতশোলে করোনা বিধি মেনেই পড়াশোনা।

করাতশোলে করোনা বিধি মেনেই পড়াশোনা। —নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২১ ০৬:১৭
Share: Save:

করোনা কালে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনার পাটই চুকে গিয়েছিল মানিক, পূজা, ঝিনুকদের। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগও ভুলে গিয়েছিল। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক এলাকার অভাবী পরিবারের এই সব পড়ুয়াদের কারও বাড়িতে স্মার্ট ফোন নেই। অনলাইন ক্লাস ওদের কাছে স্বপ্ন।

বেলপাহাড়ি ব্লকের হাড়দা পঞ্চায়েতের করাতশোল গ্রামের পড়া-ছুট এই সব ছেলেমেয়েদের কাছেই মুশকিল আসান হয়ে উঠেছেন গ্রামের দুই যুবক বিপ্লব শ্যামলী ও নয়ন সিং। গত ছ’মাস ধরে গ্রামের এক সরকারি ভবনে নিখরচায় পড়াচ্ছেন তাঁরা। গ্রামের সিংহভাগ বাসিন্দা দরিদ্র দিনমজুর। ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। অভিভাবকদেরও একটা বড় অংশের অক্ষর পরিচয় নেই। ফলে, এই সব পড়ুয়াদের পড়ানোটা আদৌ সহজ কাজ নয়। তার উপর এতজনকে পড়ানোর প্রাক-অভিজ্ঞতাও নেই ওই দুই যুবকের। সে কাজেই মুশকিল আসান হয়েছে ‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটি’। বিপ্লব-নয়নরা কী ভাবে পড়াবেন সেই পথই বাতলে দিচ্ছে তারা।

রাজ্যের সর্বস্তরের শিক্ষাকর্মীদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটি’ করোনা কালে বিভিন্ন জেলায় স্বেচ্ছাশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কী ভাবে পড়াতে হবে সে ব্যাপারে স্বেচ্ছাশিক্ষকদের জন্য একটি পাঠদানের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি, সহজ ভিডিয়োর মাধ্যমেও বিষয়গুলি স্বেচ্ছাশিক্ষকদের বোঝানো হচ্ছে। করাতশোলের স্বেচ্ছাশিক্ষক বিপ্লব ও নয়নের অবশ্য স্মার্ট ফোন নেই। সংগঠনের তরফে তাই তাঁদের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন সোসাইটির ঝাড়গ্রাম জেলা আহ্বায়ক স্বরূপচন্দ্র বিশুই।

২০১৬ সালে গড়ে ওঠা ‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটি’র মাথায় রয়েছেন গবেষক ও সমাজকর্মী কুমার রানা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতার অধিকর্তা অচিন চক্রবর্তী, শিক্ষাব্রতী তপন প্রামানিক প্রমুখ। স্বরূপ বলছেন, ‘‘স্কুল খুললেও সমস্যার আশু সমাধান আমরা দেখছি না। স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি তাই সংগঠনের উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে স্বেচ্ছাশিক্ষকদের দিয়ে স্কুলের সময়ের বাইরেও সেবামূলক অবৈতনিক পাঠদানের কর্মসূচি চলবে।’’

সেই কার্যক্রমেরই অঙ্গ ৩৩ বছরের বিপ্লব ও ৩০ বছরের নয়ন। অভাবের সংসারে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আর পড়াশোনা করতে পারেননি দু’জনেই। এখন চাষাবাদ করেন। করোনা কালে স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামের ছেলেমেয়েদের সমস্যা বুঝেই গত এপ্রিল থেকে স্থানীয় ফ্লাড সেন্টারে ক্লাস শুরু করেন তাঁরা। পরে এলাকার সমাজকর্মী শ্যামল প্রতিহারের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটি’র সঙ্গে।

স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল ও হাড়দা হাইস্কুলের পড়ুয়াদেরই নিখরচায় পড়ান বিপ্লব ও নয়ন। রবিবার বাদে সপ্তাহে ছ’দিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত ৫৫ জনকে পড়ানো হয়। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল স্বেচ্ছা-শিক্ষাদানের সেই আসরে সব পড়ুয়ার মুখে মাস্ক। আট বছরের মানিক চাকড়ি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। মানিকের বাবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। মা মারা গিয়েছেন। সপ্তম শ্রেণির পূজা চাকড়ির আবার বাবা নেই। মা দিনমজুরি করেন। পূজার দাদা কাশীনাথ উচ্চ মাধ্যমিকের পরে পড়া ছেড়েছেন। এদের সকলেরই ভরসা এই দুই শিক্ষক। পূজার কথায়, ‘‘আমারও পড়া বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু এই দুই স‌্যর তা হতে দেননি।’’ ষষ্ঠ শ্রেণির ঝিনুক শ্যামলীও জানায়, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকায় আমারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন গ্রামের বিনে পয়সার কোচিংয়ে নিয়মিত পড়ছি।’’

প্রশিক্ষণে তাঁরা উপকৃত হচ্ছেন, জানালেন দুই স্বেচ্ছাশিক্ষক। বিপ্লব বলছেন, ‘‘শিক্ষা আলোচনা সোসাইটির প্রশিক্ষণে পড়ানোর ধরন পাল্টেছি। শুধু রিডিং পড়ানো নয়, একটি বিষয় সমবেত আলোচনার মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে। তারপরে ওরা লিখছে।’’ নয়ন জুড়ছেন, ‘‘পড়ুয়ারা দোকান বাজারে জিনিস কেনে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই যোগ-বিয়োগ শেখানো হচ্ছে। কেউ দোকানি সাজছে, কেউ ক্রেতা। এতে শেখাটা সহজ হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Belpahari Pandemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE