দার্জিলিং মানেই টয় ট্রেনের নস্টালজিয়া...
দার্জিলিং
এই পাহাড়ে কারণে-অকারণে, যখন তখন চলে আসা যায়। যে পাহাড়ের কোলে মেঘ, কুয়াশা, রোদ্দুরের অবাধ আসা যাওয়া। আর ইচ্ছে হলেই হিমকন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘা তার রূপের বাহার মেলে ধরে। টলিউড, বলিউড এই পাহাড়ে তাদের শুটিং সেরে নেয় যখন-তখন। টুং, সোনাদা, ঘুম, বাতাসিয়া লুপের সঙ্গে সাপলুডো খেলতে খেলতে একরাশ কালো ধোঁয়া ছেঁড়ে খেলনা রেল এসে দাঁড়ায় নস্ট্যালজিক এই শৈলশহরে। সেই পাহাড়ের রানির নাম, দার্জিলিং। শহর যতই ঘিঞ্জি হোক না কেন, কুছ পরোয়া নেহি! সারা বছর ভিড় লেগেই থাকে। পায়ে পায়ে চলে আসুন ম্যালে। জমজমাট, আড্ডাবাজ, সেলফিপ্রেমীদের ভিড় সবসময় লেগেই আছে। খাদের ধারে রেলিং আর তার ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তার। সন্ধ্যার আলোকমালায় সেজে ওঠে দার্জিলিং। কাকভোরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে মুড়ে চলে আসুন ১১ কিমি দূরে ২,৫৯০ মিটার উচ্চতায় টাইগার হিলে। ভোরের প্রথম আলো ছুঁয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। এর পর ঘুরে দেখে নিন দার্জিলিংকে। রক গার্ডেন, পিস প্যাগোডা, মহাকাল মন্দির, তেনজিং নোরগে মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, পদ্মজা নাইডু জুলজিকাল পার্ক, রক গার্ডেন, গঙ্গামাইয়া পার্ক। দার্জিলিং থেকে একটু দূরে শান্তিস্তূপ, ঘুম মনাস্ট্রি, সোনাদা মনাস্ট্রি দেখে নিন। পাখির চোখে চা বাগান দেখতে হলে অবশ্যই চড়ে বসুন কেবলকারে। এখান থেকে দার্জিলিং দেখতে অসাধারণ লাগে। আর অবশ্যই চেপে বসুন টয় ট্রেনের জয় রাইডে। পাহাড়, খাদের ধার ঘেঁষে দার্জিলিং দর্শন, এক অসাধারণ নস্ট্যালজিয়া।
আরও পড়ুন: লাচুং-ইয়ুমথাং-লাচেন-গুরুদোংমার
পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে ছবির মতো দার্জিলিং
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে অথবা বিমানে এনজেপি হয়ে গাড়িতে চলে আসুন দার্জিলিং।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রাজ্য পর্যটন দফতরের টুরিস্ট লজ (০৩৫৮-২২৫৪৪১২) ভাড়া ১,৬০০-৩,৮০০ টাকা। জি টি এ ম্যাপল ট্যুরিস্ট লজ (০৩৫৮- ২২৫৪৪১৩) ভাড়া ২,০০০-২,৭০০ টাকা।
প্রাইভেট হোটেলের মধ্যে মাউন্ট মেরিডিয়ান (২২৫৩৫৯১) ভাড়া ১,০৫০-৩,৫০০ টাকা। হোটেল এলিমেন্ট (২২৫৫৫২১) ভাড়া ১,২৫০-১,৮৫০ টাকা। বেলভিউ হেরিটেজ (২২৫৪১৭৮) ভাড়া ১,৫০০-২,৫০০ টাকা। অ্যালিস ভিলা ( ২২৫৪১৮১) ভাড়া ১,৮৫০-২,৫৫০ টাকা।
দার্জিলিং-এ নেপালি প্রর্থনা সভাগৃহ
কালিম্পং
পাহাড়ের কোলে আরও এক সাজানো শহর। ডেলো আর দুরপিনদাঁরা, এই দুই পাহাড়ের খাঁজে আরও এক শৈলশহর। নীল আকাশের মাঝে মেঘের পানসি, মেঘ আর কুয়াশা যেন কুমিরডাঙা খেলে। ভাসতে ভাসতে মেঘের দল ঢুকে পড়ে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা সারি সারি বাক্সবাড়ির অন্দরমহলে। ৪,১২৫ ফুট উচ্চতার এই শহরের নানা ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন রয়েছে। রেশমপথের গুরুত্বপূর্ণ এই শহরে সুদূর তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীরা জেলেপা লা পার করে কুপুপ, জুলুক, আরিতার, পেডং হয়ে টানা এক মাস চলার পর কালিম্পংয়ে আসতেন। এখান থেকে দেশের নানা প্রান্তে সেই রেশম রফতানি হত। ১৮৭০ সালে ভুটান রাজার থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয় এই শহর। সেজে ওঠে শহর। এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান দ্রষ্টব্য। ঘুরে দেখে নিন।
চলে আসুন ডেলো পার্কে। ডেলো জলাধারের পাশেই এক সাজানো পার্ক। রয়েছে বসার চেয়ার। রঙিন ফুল ফুটে থাকে চারপাশের টিলার ধাপে ধাপে। মেঘমুক্ত আকাশে, পাইনের ফাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সুখী পরিবারের দেখা মেলে। আর টিলার মাথায় সুন্দর ডেলো বাংলো, বুকিং থাকলে সে বাংলোয় রাত্রিবাস করা যায়।
আর যাঁরা পাখির চোখে কালিম্পংকে দেখতে চান, তাঁরা সাহসে ভর করে ভেসে পড়ুন প্যারাগ্লাইডিং-এ। এ ছাড়াও ডক্টর গ্রাহাম’স হোম, মঙ্গলধাম, ম্যাকফারলেন চার্চ, দুরপিনদাড়া গুম্ফা, দুরপিনদাড়া ভিউপয়েন্ট, হনুমান পার্ক, দুর্গামন্দির, কালীমাতা মন্দির, মরগ্যান সাহেবের বাংলো, জং ডং পালরি ফো-ব্রাং মিউজিয়াম আর ক্যাকটাসের অনবদ্য সম্ভার দেখতে হলে চলে আসুন পাইন ভিউ নার্সারিতে। নামী ক্যাকটাস সমেত নানা অর্কিডের সেরা সম্ভার আর এখান থেকে কালিম্পংকে অসাধারণ লাগে।
আরও পড়ুন: দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় মায়াবী সিকিম
পায়ের নীচে শহর কালিম্পং
কালিম্পংয়ে রয়েছে নানা কিউরিও শপ। এখান থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন মুখোশ-সহ নানা অ্যান্টিক কালেকশন। দরদাম না করে নিলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়িতে ৭৫ কিমি।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতরের ট্যুরিস্ট লজ (০৩৫৫২-২৮৩২৯২) ভাড়া ২,২০০-৩,০০০ টাকা। তাসিডাং ট্যুরিস্ট লজ (২৮৩২৯২) ভাড়া ১,২০০- ২,৮০০ টাকা। বন দফতরের নেচার রিসর্ট (www.wbfdc.com) ভাড়া ১,২০০-১,৫০০ টাকা।
বেসরকারি হোটেলের মধ্যে হোটেল পারিজাত (২৫৬৬৯৮) ভাড়া ১,৫০০-১,৮০০ টাকা। গোম্পুস হোটেল (২৫৫৮১৮) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০ টাকা। মাউন্টেন ভিউ (২৫৫১২৩) ভাড়া ১,৪৫০-১,১৮০০ টাকা। ডেকি লজ (২৫৫০৯৫) ভাড়া ১,০৫০-২,০৫০ টাকা।
আরও পড়ুন: সামাটার... ছালামথাং... রাবংলা... নামচি...
লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ
পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মতো সৌন্দর্যে ভরপুর এক হিমেল ঠিকান। নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের উদ্ধত পাইনের বন এসে মিশেছে পাহাড়ের ঢালে। আর তারই মাঝে মাঝে সারি সারি বাক্সবন্দি বাড়ি। লাভার কাছেই লাভা মনাস্ট্রি। সুন্দর গুম্ফায় লামাদের স্কুল। সুন্দর মনাস্ট্রি, মেঘমুক্ত আকাশে এই গুম্ফার বারান্দা থেকে হিমেল পর্বতশ্রেণীদের দেখা মিলবে। লাভা থেকে তিন কিমি দূরে শেরপা ভিউপয়েন্ট। রেচেলা লা, জেলেপ লা-সহ নানা শৃঙ্গরাজের দেখা মেলে। লাভা থেকে নানা আকর্ষণীয় ট্রেকরুট রয়েছে। তবে যাঁরা হাল্কা ট্রেক পছন্দ করেন তাঁরা অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন ছাঙ্গে ফলস। পাইন, ধুপির পরশ জড়ানো এ পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই রোমাঞ্চ। প্রতি মুহূর্তে নানা বন্যপ্রাণের আনাগোনা। মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরে। মায়াময় পথে পাখির কলতান শুনতে শুনতে চলে আসুন এক সুন্দর ঝর্নার কাছে। ছাঙ্গে ফলস। পাহাড়, জঙ্গল থেকে চুঁইয়ে আসা সূর্যের আলোকমালায় সেই ঝর্নার গায়ে রামধনু তৈরি হয়।
দূরে লুকোচুরি খেলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ফাইল চিত্র
লাভা থেকে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে প্রায় ২৪ কিমি দূরে পাইন, ফার, জুনিপার আর ক্রিপ্টোম্যানিয়ার বনের ছায়ায় আরও এক পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাঁও। তবে এখানকার তারের জালি দিয়ে ঘেরা বিখ্যাত ক্যানোপি ট্রি-র এখন সংস্কারের কাজ চলছে। ভোরের সূর্যোদয় আর রাতে লক্ষ তারায় ভরা আকাশে, নীচের বিস্তৃত উপত্যকায় জ্বলছে আলোকমালা, ঠিক যেন হীরকদ্যুতির আভায় মন ভরিয়ে দেয়।
রিশপ আরও এক পাহাড়িয়া গ্রাম, যে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় শোভা পায় রঙিন ফুল আর নানান অর্কিড। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে আকাশে হিমালয়ের হিমকন্যাদের দর্শন মেলে। লাভা থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে। ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত এই পাহাড়ি গ্রামে প্রচুর পাখি আর আকাশের ক্যানভাসে একফ্রেমে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ নানা অল্প চেনা শৃঙ্গের দেখা মেলে। সুন্দর সূর্যোদয় দেখতে হলে প্রায় ২ কিমি জঙ্গল ট্রেকে চলে আসুন টিফিনদারা ভিউপয়েন্টে। এখান থেকে দেখা সূর্যোদয় অনেক দিন স্মৃতির হার্ডডিস্কে থেকে যায়।
লোলেগাঁও-এর পালা খোলা ব্রিজ দিয়ে হেঁটে আসছেন এক নেপালি বৃদ্ধ। ফাইল চিত্র
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ মাল জংশনে নেমে গাড়িতে লাভা চলে আসা যায়। লাভা থেকে লোলেগাঁও ২৪ কিমি। লাভা থেকে রিশপ ১২ কিমি।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে বন উন্নয়ন নিগমের (www.wbfdc.com) রিসর্ট।
বেসরকারি প্রচুর হোটেল রয়েছে। হিমালয়া ইন (৯৮৩৬৫০৯৯৩৩) ভাড়া ১,০০০-২,০০০ টাকা। হোটেল ইয়াঙ্কি (৯৯৩২৮৬৯২০৫) ভাড়া ১,২০০-২,৮০০ টাকা।
লোলেগাঁওতে থাকার জন্য হোটেল সানরাইজ (৩০২৩-০৪০০) ভাড়া ১,০০০-১,৫০০ টাকা। পিনাশা লজ (৮১১৬২১৪১৯৯) ভাড়া ১,৫০০ টাকা। লাভলি রিসর্ট (৯৪৩৩২- ৫৮১৫৭) ভাড়া ১,১০০-১,৫০০ টাকা।
রিশপে থাকার জন্য রয়েছে লাভলি রিসর্ট (৯৮৩০২৫২৮৪৩) ভাড়া ১,২০০-১,৬০০ টাকা। প্যারাডাইস ভিলা (৯৪৩২৮০০৩৬৭) ভাড়া ৮০০-১,২০০ টাকা।
(লেখক পরিচিতি: ক্লাস নাইনে পড়াকালীন পাড়াতুতো মামার সঙ্গে মাত্র ৭০০ টাকা পকেটে নিয়ে সান্দাকফু ট্রেক। সুযোগ পেলেই প্রিয় পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া। বছরে বার কয়েক উত্তরবঙ্গের অল্পচেনা ডেস্টিনেশনে যাওয়া চাই। কুয়াশামাখা খরস্রোতা নদী কিংবা চলমান জীবনছবিতে ক্লিক, ক্লিক। চলতি পথে মেঠো গানের সুর শুনলেই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়া। লাদাখে গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়া মারমটের ছবি তুলতে ভিজে মাটিতে সটান শুয়ে অপেক্ষায় থাকা— এই নিয়েই ক্যামেরা আর কলম সঙ্গী করে ২২টা বছর। প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ানোটা থামেনি।)
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy