দশম ফলস।
ডিসেম্বরের ছুটির একদম শেষ মুহূর্তে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বসে মাথায় হাত। কোথাও কোনও জায়গা নেই। ট্যুর অপারেটররা পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন পুরো ডিসেম্বর জুড়েই প্রায় সব জায়গায়, সব হোটেলই হাউসফুল।
ভরসা ছিল ঝাড়খণ্ড। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। ঘাটশিলায় এক বন্ধুকে ফোন করতে, তার সপাট জবাব, ঘাটশিলা, গালুডির বুকিং এখন আর সম্ভব নয়। কালীপুজোর কিছু দিনের মধ্যে ঘাটশিলার ভাল সব হোটেলের বুকিং হয়ে গিয়েছে। বেতলা বা নেতারহাট? সেখানেও ডিসেম্বরে নো ভ্যাকেন্সি।
জলে হাবুডুবু খেতে খেতে যখন কেউ হাত বাড়িয়ে টেনে তোলে তখন তার থেকে পরম বন্ধু আর কেউ হয় না। ঠিক সেরকমই হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল ঝাড়খণ্ডেরই এক বন্ধু। কর্মসূত্রে রাঁচীর বাসিন্দা ওই বন্ধু ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে জানাল, পরিবারকে নিয়ে চলে আয় রাঁচী। তোদের রাঁচীর কাছে পত্রাতু ভ্যালি নিয়ে যাব।
পত্রাতু উপত্যকা সেটা কোথায়? পত্রাতু নিশ্চই পাতে দেওয়ার মতো জায়গা নয়, তাই ডিসেম্বরেও পর্যটকদের ভিড় নেই।
ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বন্ধুর সহাস্য উত্তর, রাঁচীতে অনেক ছোটো বড় হোটেল রয়েছে। তাই এখানে জায়গা পেতে অসুবিধা নেই। একবার পত্রাতু উপত্যকা এলে মনে হবে এই উপত্যকার আশপাশে কোথাও একটা জমি কিনে ঘর বানিয়ে চির দিন থেকে যাই। শুধু পত্রাতু উপত্যকাই তো নয়, রাঁচীর আশপাশে পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা হুড্রু, জোনহা, দশম ফলসও তো রয়েছে।
রাঁচী থেকে কাঁকে রোড ধরে আধঘণ্টা গাড়িতে যাওয়ার পরে উপত্যকাটা শুরু হতেই বুঝতে পারলাম এ বার ক্যামেরা বের না করে উপায় নেই। জঙ্গল আর পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে একটি রাস্তা ওপরে উঠে গিয়েছে। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে সবুজ উপত্যকা। সেই সবুজ ভ্যালিতে শীতের মিঠে রোদ পড়ে পিছলে যাচ্ছে। শেষে উপত্যকার ভিউ পয়েন্টে উঠে দেখা গেল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা আর জঙ্গল। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা পাহাড় ঘেরা বিশাল জলাশয়ও। টলটলে জল। তবে ভিউ পয়েন্টের সব থেকে আকর্ষণীয় জায়গা হল পাহাড়ি রাস্তাটা। মনে হবে অনেকগুলি পাহাড়ি রাস্তা যেন পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়েছে। কিন্তু আদতে ওটা একটিই রাস্তা।
টেগর হিল।
দূরবীণ দিয়ে ওই হ্রদটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলাম ওই জলাশয়ে বোটিং হয়?
শুধু বোটিংই নয়, বন্ধু জানাল, ওই পত্রাতু ড্যামের ধারে সতরঞ্চি পেতে পিকনিকও করা যায়।
উপত্যকা থেকে নেমে পত্রাতু ড্যামে বোটিং ও সতরঞ্চি পেতে পিকনিক করতে করতে মনে হল ভাগ্যিস এই ভ্যালির কথা বলেছিল বন্ধু। পাহাড়, জঙ্গল, বিশাল জলাশয় আর নানা অজানা পাখির সম্ভারে পত্রাতু উপত্যকার তুলনা করতে গেলে একটা কথাই বলতে হয়, ‘‘তোমার তুলনা তুমি।’’
আমরা যখন উপত্যকা থেকে ফিরছিলাম তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পত্রাতু ভ্যালি থেকে সূর্যাস্তও দেখা হয়ে গেল। বন্ধুটি জালাল, এই পত্রাতু উপত্যকায়ই ঝাড়খণ্ড সরকার ফিল্মসিটি বানাচ্ছে।
পত্রাতু উপত্যকা থেকে ফেরার সময় মনে হল সত্যিই বন্ধুর কথাই ঠিক। এখানে যদি একটু জমি পাওয়া যেত! তবে শুধুই পত্রাতু নয়, রাঁচীর আশপাশে যে জলপ্রপাতগুলি আছে সেগুলিই বা মিস করবেন কেন?
পরের দিন গাড়ি ভাড়া করে রাঁচী থেকে চলে গেলাম হুড্রু, জোনা আর সীতা জলপ্রপাত দেখতে। রাঁচী শহর থেকে বেরিয়ে একটু পথ গেলেই শুরু হয়ে যায় পাহাড় আর জঙ্গল। এই তিনটে জলপ্রপাত একই পথে পড়ে। পাহাড় আর জঙ্গলে ঢাকা জলপ্রপাতের জলের ধারা শীতে একটু কম থাকলেও মন ভরে যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে। জলপ্রপাতগুলি দেখতে অনেকগুলি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শুনতে পাওয়া গেল জলপ্রপাতের গর্জন। কিন্তু আর কতদূর নামতে হবে? বন্ধুটি জানাল, কোনও সুন্দর জিনিস কী সহজে ধরা দেয়? সিঁড়ি দিয়ে নেমে জলপ্রপাত দেখে উপরে ওঠার সময় হাঁফ ধরে গেলেও চিন্তা নেই। সিঁড়ির ধাপে বসে একটু জিরিয়ে নিন। জোরে জোরে বুক ভরে নিশ্বাস নিন। সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। এত বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর কোথায় পাবেন?
পরের দিন রাঁচী থেকে জামশেদপুর যাওয়ার রাস্তার ধারে প্রথমে দশম জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাত দেখতে বেশি সিঁড়ি ভাঙতে হয় না। সহজেই ধরা দেয় দশমের সৌন্দর্য্য। দশমের যে জলের ধারা নেমে আসছে সেখান থেকে এক আঁজলা জল তুলে ইচ্ছা করলে পান করতে পারেন। তবে সাবধানে। দশম ফলসের পাথর থেকে পা পিছলে পড়ে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে।
দশম জলপ্রপাত দেখে একটু এগিয়েই দেখে নেওয়া গেল সূর্যমন্দির। সূর্যমন্দিরের ভেতরের কারুকার্য মুগ্ধ করে দেয়। সূর্যমন্দির থেকে একটু এগিয়ে ঘুরে আসা যায় দেউরি মন্দিরও। দেউরি মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নাম। ধোনি এই মন্দিরে এসে নিয়মিত পুজো দেন।
পরের দিন বেরিয়ে পড়া গেল রাঁচী থেকে দু’ঘন্টার পথ রাজরাপ্পা মন্দিরের দিকে। এই রাজরাপ্পার পটভূমিতেই সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ফেলুদার গোয়েন্দা উপন্যাস ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। রাঁচী থেকে রাজরাপ্পা যাওয়ার পুরো পথটাই প্রাকৃতি তার সৌন্দর্য্য উপুড় করে দিয়েছে। কখনও পাকদণ্ডী পথ। কখনও জঙ্গল। কখনও ছোটো নদী। সব পেরিয়ে রাজরাপ্পা পৌঁছনো গেল। মন্দিরে ভিড় থাকে সব সময়।
তাই পুজো দেওয়ার সুযোগ না মিললেও মন্দিরের গা ঘেঁষে দামোদর আর ভৈরবী নদীর সঙ্গমস্থল দেখলেই মন ভরে যাবে। ভৈরবীতে ইচ্ছা করলে বোটিংও করা যায়।
পরের দিন শুধুই রাঁচী শহর ভ্রমণ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত টেগোর হিল, রক গার্ডেন, পাহাড়ের ওপর জগন্নাথ মন্দির, রাঁচীর বিরসা মুণ্ডা চিড়িয়াখানা এক দিনে দেখে নেওয়া যায়। তবে বিরসা মুণ্ডা চিড়িয়াখানা এতটাই বড় এবং সুন্দর যে দেখতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
রাঁচী শহর ঘুরতে ঘুরতে হরমু রোডে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বাড়ি দেখতে ভুলিনি। রাস্তার অটোওয়ালা থেকে পানের দোকানদার সবাই ধোনির বাড়ির রাস্তা বলে দিতে পারে। ধোনির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনেক পর্যটক সেলফিও তুলছিলেন। তবে ধোনি এখন রাঁচীর রিং রোডে একটি বিশাল ফার্ম হাউসও তৈরি করেছেন। সেখানেই এখন বেশিরভাগ সময় থাকেন। মনে হল রাঁচী ঘোরার শেষ দিন ধোনির বাড়ি যেন নিমন্ত্রণ বাড়ির সব খাবারের শেষে মিঠা পান। পান না খেলে যেমন মনে হয় বিয়ের বাড়ির খাবারটা অসম্পূর্ণ তেমনই রাঁচীতে এসে ধোনির বাড়ি না দেখলে রাঁচী ঘোরাটাই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ছবি লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy