Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মস্তানির ভাষা

বল, আলু মানে বোমা। চপ্পল মানে বন্দুক। মিস্ত্রি মানে পকেটমার, ডাব্বা মানে মোবাইল। অপরাধ-জগতের নিজস্ব ভাষাও চমকপ্রদ। সুরবেক বিশ্বাস বল, আলু মানে বোমা। চপ্পল মানে বন্দুক। মিস্ত্রি মানে পকেটমার, ডাব্বা মানে মোবাইল। অপরাধ-জগতের নিজস্ব ভাষাও চমকপ্রদ। সুরবেক বিশ্বাস

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সওদাবাজি’ পর্যন্ত ঠিক ছিল। তবে ‘কাঠি পেহনানো’-র কথা বলা হয়নি। অথচ সেটাই হল। আর তার জেরে হুলস্থূল। এতটাই যে, পুলিশের একাংশ কার্যত বিদ্রোহ করে বসলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়!

দু’বছর আগে কলকাতা পুরভোটের দিন বিকেল। গিরীশ পার্ক এলাকায় শাসক দলের মদতপুষ্ট গুন্ডাদের গুলি লাগে সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলের কলার বোন-এ। তবে মোটর বাইকে চড়াও হওয়া ওই মস্তানদের বলা হয়েছিল স্রেফ ‘সওদাবাজি’ করতে।

‘সওদাবাজি’। না, ব্যবসা-বাণিজ্য বা দরদস্তুর করার কথা বলা হচ্ছে না। এখানে ‘সওদা’ মানে ‘বোমা’। কাজেই, ‘সওদাবাজি’ মানে ‘বোমাবাজি’, অন্য কিছু নয়। বোমাকে অবশ্য ‘বল’, ‘আলু’ও বলা হয়। আর বন্দুকের গুলি বা কার্তুজকে ‘কাঠি’ বা ‘কাটি’ কিংবা ‘সিগারেট’।

এসআই জগন্নাথবাবুকে যারা গুলি করেছিল, তাদের উপর নির্দেশ ছিল, অপোনেন্ট পার্টি এরিয়ায় ‘গুদাল’, মানে গন্ডগোল করছে। তাই, ‘সওদাবাজি’ করতে হবে ওদের হটাতে। সেটাই করা হচ্ছিল। সবই চলছিল পরিকল্পনা মাফিক। কিন্তু হঠাৎ এক জন বেমক্কা গুলি ছুড়ে দিল পিস্তল থেকে। আর তাতেই লুটিয়ে পড়লেন পুলিশ অফিসার। সেই রাতে পুলিশ বাহিনীর অনেকের ক্ষোভের আগুন বেরিয়ে এসেছিল ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া ভূরি ভূরি পোস্ট ও কমেন্টে। জগন্নাথ মণ্ডলকে লুটিয়ে পড়তে দেখেই দুর্বৃত্তেরা বলেছিল, ‘এরিয়া গরম হয়ে গিয়েছে, ইঁহাসে খুল।’ মানে ‘এখান থেকে ভেগে পড়’।

গিরীশ পার্কের মতো হইচই ফেলে দেওয়া ঘটনা তো বটেই, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-পকেটমারিও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় অপরাধ বা দুষ্কর্ম। আর সেয়ানা ছেলে, অর্থাৎ অপরাধ-জগতের সঙ্গে জড়িত বা সমাজবিরোধীদের ভাষায় ‘কান্‌ড করা’। সেয়ানা লাইনের কীর্তিকলাপ যেমন ছাপোষা মানুষদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়, তেমনই ওই লাইনের ভাষাও আলাদা। সে ভাষা হদিশ দেয় এক আলোছায়াময় জগতের।

এ সব শব্দকে ঠিক সাঙ্কেতিক শব্দ বা কোড বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। এ হল অপরাধ-জগতের নিজস্ব ভাষা। বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ সৃষ্টিতে এক-একটি শব্দ চয়নের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। এই ভাষা যেন আলেয়ার আহ্বান, বিপদ অবশ্যম্ভাবী জেনেও তার ডাক এড়ানো মুশকিল। অথচ একে ঠিক খিস্তি-খেউড় বলা যাবে না মোটেই, অশ্লীল বলাটাও খানিক বাড়াবাড়িই হবে। এ ভাষা অনেকাংশেই চমকপ্রদ।

ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক এ ভাষাকে ‘পাতালপুরীর ভাষা’ বলে অভিহিত করেছেন তাঁর ‘অপরাধ জগতের ভাষা ও শব্দকোষ’-এ। যেটি কিনা এই বিষয়ের আকরগ্রন্থ ও প্রামাণ্য হিসেবে পরিচিত। প্রায় সিকি শতক আগে প্রকাশিত ওই গবেষণাগ্রন্থে যা লেখা হয়েছে, অপরাধ-জগতের ভাষা এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা হয়তো বলা যাবে না, তবে তার মূল অবয়ব মোটামুটি অক্ষুণ্ণ।

এখনও পকেটমারদের বলা হয় ‘টিংবাজ’, ‘তালবাজ’ কিংবা ‘মিস্ত্রি’। ‘মিস্ত্রি’ যখন কাজ করবে, সেই সময়ে যে শিকারের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দৃষ্টিপথ আড়াল করে দেবে, সেই সহকারীর নাম ‘ঠেকবাজ’। তার এই কাজের নাম হল, ‘ছপ্পর দেওয়া’। সেই জন্য তার আর এক নাম ‘ছপ্পরবাজ’। এ সবই কিন্তু ভক্তিপ্রসাদবাবুর শব্দকোষ-এ ঠাঁই পেয়েছে। রচয়িতা ১৯৬০ সাল থেকে দীর্ঘ দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ ও অবিভক্ত বিহারের বহু জেলখানা ঘুরে অপরাধ-জগতের ভাষার নানা মণিমাণিক্য তুলে এনেছিলেন। আর এখন অনূর্ধ্ব তিরিশ বছর বয়স, কলকাতার অপরাধ-জগতের এমন কয়েক জন যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, ওই সব শব্দ ইদানীং কালেও বহুল ব্যবহৃত। গলার হারকে ‘সুতো’, খুচরো পয়সাকে ‘চিল্লর’ এই সময়েও বলা হচ্ছে। তবে পকেটমারিকে এখন বলা হয় ‘ওয়াচ করা’। আবার দুর্বৃত্তদের শিকার যি‌নি, তাঁকে বলা হয় ‘গিবার’। আগে তাঁকে মূলত ‘ধুর’ বলার চল ছিল। পকেটমারদের শিকার যে ব্যক্তি বা মহিলা, তিনি আগেভাগে বুঝে সতর্ক হয়ে গেলে, ঠেকবাজকে টিংবাজ বলবে, ‘গিবার বজ্জন হো গয়া’ কিংবা ‘গিবার বম হো গয়া’।

১৭ বছর আগের একটি খুনের খবর করার সূত্রে পরিচিত হওয়া গিয়েছিল আর এক অপরাধ-শব্দের সঙ্গে। ‘গব্বা’। গিরীশ পার্কের হিরে ব্যবসায়ী কিশোর হিরাওয়াতকে প্রথমে অপহরণ করা হয়েছিল। মুক্তিপণ চেয়ে ফোনও এসেছিল বাড়িতে। কিন্তু দু’দিন পর তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অপরাধীদের দল ধরা পড়ার পর জানা গিয়েছিল,গব্বার সমস্যার কথা। অপরাধ-জগতের ভাষায়, ‘গব্বা’ মানে অপহৃতকে লুকিয়ে রাখার ডেরা। ভক্তিপ্রসাদবাবুর বইয়ে আবার শব্দটার দু’রকমের অর্থ ও প্রয়োগ আছে। কখনও তার মানে ঘর বা বাড়ি (চুরির বা অপরাধের জায়গা), আবার চোলাই মদের ঠেকও। কিশোরকে যারা অপহরণ করেছিল, তারা তখন ছিল ওই লাইনে কাঁচা। ঠিকঠাক গব্বা জোগাড়ের আগেই অপহরণ করে ফেলেছিল তারা। ঝুঁকি হয়ে গিয়েছে দেখে, ভয় পেয়ে হিরে ব্যবসায়ীর মাথায় গুলি করা হয়।

অতীতে ট্রেনে মিস্ত্রি, ঠেকবাজেরা ওয়াচ করলে বলা হত, ‘বড় চাকায় কাজ’। এখন ট্রেনকে বলা হচ্ছে ‘লোহা’। বাস, ট্রামকে বলা হত ‘ছোট চাকা’। এখন শুধু ‘চাকা’, ট্রেনকে ‘লোহা’ নাম দিয়ে ‘চাকা’ গোত্র থেকে আলাদা করা হয়েছে। পুলিশের গাড়িকেও ‘চাকা’ বা ‘চাক্কা’ বলা হয়। আর পকেটমারি বা ছিনতাই করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে গেলে শেষ অস্ত্র হিসেবে ‘তাসবাজি’ করে বেরোতে হবে। ‘তাসবাজি’ মানে ব্লেড বা ক্ষুর চালানো। কাজে সফল হলে ‘পয়দা কো ভুড়ি কর’-এর ব্যাপারটা আসবে। ভক্তিপ্রসাদ মল্লিকের শব্দকোষ-এ ‘ভুড়ি’-কে ঘুষের টাকা বলা হয়েছে। ‘পয়দা কো ভুড়ি কর’ মানে ‘লুঠের মাল ভাগ কর’।

শব্দ ও তার আগেকার একটি অর্থ এক আছে, কিন্তু এখন সেই রূপে তার ব্যবহার বেশি হচ্ছে, এ রকম একটি উদাহরণ, ‘বিলা’। ‘কৃষ্ণ করলে লীলা আর আমরা করলে বিলা’ তো প্রায় প্রবাদবাক্যে পরিণত। তবে অপরাধ-জগতে সাধারণ ভাবে ‘বিলা’ মানে গন্ডগোল বা খারাপ কাজ নয়। অন্তত এক ডজন অপরাধ, থুড়ি ‘কান্‌ডে’ অভিযুক্ত, পূর্ব কলকাতার এক যুবকের কথায়, ‘পুলিশ দেখতে পেলে আগে বলা হত মামা। এখন আমরা বলি বিলা।’ অপরাধ-জগতের শব্দকোষে ‘বিলা’ বলতে পুলিশ বা ইনফর্মারকে বোঝানো হয়েছে। তবে তখন সম্ভবত এখনকার মতো পুলিশ অর্থে ‘বিলা’ শব্দের প্রয়োগ খুব বেশি হত না।

আবার ‘চপ্পল’ শব্দটার অর্থ একটা সময়ে ছিল লুকনো, বা বাধা সৃষ্টি করা। এখন বন্দুককেও ‘চপ্পল’ বলা হয়। ‘এক নম্বর চপ্পল’ মানে দেশি ওয়ান শটার বন্দুক, ‘ছ’নম্বর চপ্পল’ বা ‘সিক্সার’-এর অর্থ রিভলভার। নাইন এম এম বোরের গুলি ব্যবহার করা হয় যে পিস্তলে, তাকে বলে ‘ন’নম্বর চপ্পল’। এই চপ্পল‌ না, সাধারণ চপ্পল বা চটি যা দিয়ে তৈরি হয় সেই ‘চামড়া’ মানে অপরাধ-জগতে এখনও ‘মানিব্যাগ’। মিস্ত্রি আর ঠেকবাজদের মধ্যে এই শব্দটির ঘন ঘন ব্যবহার শোনা যায়। কারণ, ট্রাউর্জাস বা জিন্‌সের পিছনের পকেট থেকে চুপিসারে ‘চামড়া’ ওঠানোর মধ্যেই তাদের দক্ষতা!

তবে ‘ডাব্বা’ বা ‘কাউয়া’, ‘আঁখওয়ালা ডাব্বা’, ‘অন্ধা কাউয়া’, ‘চুইংগাম’, ‘খাঁও’— এই সব শব্দ ভক্তিপ্রসাদবাবু পাননি। অপরাধ-জগতে এরা এখন আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, সেই সময়ে মোবাইল ফোনও ছিল না, মোবাইল ফোন চুরি ও চোরাই মোবাইলের কারবারও তাই ছিল না। মোবাইলকে বলা হয় ‘ডাব্বা’ বা ‘কাউয়া’। ‘আঁখওয়ালা ডাব্বা’ মানে ক্যামেরাওলা মোবাইল ফোন। ‘অন্ধা কাউয়া’ হল পাতি মোবাইল ফোন, যাতে ক্যামেরা নেই। সিম কার্ডকে বলে ‘চুইংগাম’, ওটা দেখতে চিকলেট-এর মতো বলে। আর চোরাই মোবাইল ফোনের কারবার যারা করে, তাদের বলে ‘খাঁও’।

এই ভাবে নতুন নতুন পণ্যের আমদানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতানোর কৌশল যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনই সেই পথ ধরে উঠে আসছে নতুন নতুন শব্দ। ভদ্র সমাজের ভাষার মতোই পালটে যাচ্ছে অপরাধ-জগতের ভাষাও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE