Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

উদ্ধার করেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের, আশ্রয়ও দেন!

বাড়ি থেকে পালানোর কৌশল বলে দেন ওঁরা।বাড়ি থেকে পালানোর কৌশল বলে দেন ওঁরা। প্রয়োজনে মারামারি করে উদ্ধার করেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের, আশ্রয় দেন।

রক্ষক: ‘লাভ কম্যান্ডোজ’-এ সদস্যরা

রক্ষক: ‘লাভ কম্যান্ডোজ’-এ সদস্যরা

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

হ্যালো স্যর, আমি নাসিকের ছেলে। বয়স তেইশ। মুসলিম। যাকে ভালবাসি সে হিন্দু, আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট। আমরা বিয়ে করতে চাই। সাহায্য করুন, প্লিজ!’’

‘‘নমস্কার ভাইয়া। আমরা রাজপুত, আমার প্রেমিক উত্তরপ্রদেশীয় ব্রাহ্মণ। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু দুই বাড়ি ভীষণ গোঁড়া। আমরা দু’জনেই খুন হয়ে যাব, আমাদের বাঁচান!’’—রোজ কয়েকশো আবেদন আসে ওঁদের ওয়েবসাইটে। কারণ তাঁরা প্রেমের রক্ষক, ‘লাভ কম্যান্ডোজ।’ প্রেমিক-প্রেমিকাকে বাঁচানো, তাঁদের প্রেমের পূর্ণতা দেওয়াই তাঁদের ঘোষিত মিশন। যে শহরের রাস্তায় কিছু দিন আগেই ভিনধর্মের মেয়েকে ভালবাসার অপরাধে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন অঙ্কিত সাক্সেনা, সেই দিল্লিতেই তাঁদের সদর দফতর।

বিভিন্ন পেশা, আর্থসামাজিক স্তর, ধর্ম-জাত থেকে উঠে আসা কিছু মানুষ স্রেফ ভালবাসাকে ভালবেসে একটা দল তৈরি করে ফেলেছিলেন ২০১১-তে। সেই দল এখন এক প্রতিষ্ঠান। সংস্থার নথি অনুযায়ী গত ছ’বছরে লাভ কম্যান্ডোদের সাহায্য পেয়েছেন প্রায় ৩০০০০ প্রেমিক-প্রেমিকা! দেশ জুড়ে এঁদের প্রায় পাঁচ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক, দিল্লি, ফরিদাবাদ, গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদে আটটি গোপন আস্তানা। সেখানে পালিয়ে আসা বা উদ্ধার করে আনা যুগলকে প্রয়োজনে মাসের পর মাস লুকিয়ে রাখা হয়, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

বাড়ি থেকে পালানোর ফর্মুলা বাতলে দেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। দরকারে পাঁচিল টপকাতে, দড়ি বেয়ে নামতে, তালা ভাঙতে সাহায্য করেন। বিশেষ প্রয়োজনে ধাক্কা, হাতাহাতি, মারামারি করে প্রেমের শত্রুদের ঢিট করার লোকও পাওয়া যায়। ট্রেন-বাসের টিকিট, ভাড়া গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়, পুলিশ-আদালতের মোকাবিলাও তাঁরা করেন। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী কিছু দিন আত্মগোপন করতে চাইলে তার জন্যও দেশ জুড়ে এঁদের ৫০০ অস্থায়ী আস্তানা আছে। পুরোটাই ‘ফ্রি সার্ভিস।’ খরচ উঠে আসে গোটা বিশ্ব থেকে আসা ডোনেশনের টাকায়।

আমির খান তাঁর টিভি-অনুষ্ঠানের একটি পর্ব করেছিলেন লাভ কম্যান্ডোদের নিয়ে। খান চারেক তথ্যচিত্র হয়েছে তাঁদের উপর। নিজস্ব ‘থিম সং’ রয়েছে সংস্থার। প্রতিদিন সকালে প্রেমযোদ্ধারা কাজ শুরু করার আগে তাতে গলা মেলান। আছে নিজস্ব ‘লোগো’, খাকি উর্দি পরা এক গোঁফওয়ালা লোক দু’হাতে দু’টি রিভলভার নিয়ে ত্রিভঙ্গমুরারীর মতো দাঁড়িয়ে, তাঁর বুক, কপাল, ঘাড়ে লাল হৃদয়চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। ওয়েবসাইটে ২৪ ঘণ্টা ‘ব্রেকিং নিউজ’, কোন প্রেমিক-প্রেমিকাকে উদ্ধার করা হল, কোথায় কার রেজিস্ট্রি হল, ইত্যাদি।

আরও পড়ুন: চলে গেলেন বারেন্দ্র ইহুদি

আটান্ন বছরের সঞ্জয় সচদেব সংস্থার চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রীর কথায়, ‘‘আমি কিছু বলি না। পুণ্যের কাজই তো করছে।’’ সঞ্জয় হাসেন, ‘‘বউ-ই আমার প্রেরণা। ও আমাকে এত ভাল না-বাসলে কি ভালবাসার জন্য জীবন বিকিয়ে দিতে পারতাম? ভারতে ভিন ধর্মে বিয়ের পথ সুগম হলে আপনা থেকে সর্বধর্মসমন্বয় হয়ে যাবে। আকবর ব্যাপারটা বুঝেছিলেন।’’ আর এক জন হর্ষ মলহোত্র। ৪৮ বছর বয়স। এমনই প্রেমিক, যে নিজের বউকে এখনও পর্যন্ত সাত বার বিয়ে করেছেন! নরমে-গরমে প্রেম-বিরোধীদের শায়েস্তা করার মাস্টারপ্ল্যানে ওস্তাদ তিনি।

তৃতীয় জন সোনু রাংগি। পরিচিতি সোনু হিজরা নামে। দিল্লির শিবসেনা দলে ছিলেন। ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র দিন রাস্তায় প্রেমিক-প্রেমিকার উপর চড়াও হতেন। সেই তিনিই শিবসেনা ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রেমের পাহারাদার! প্রেমিক-প্রেমিকা উদ্ধারের ‘অ্যাকশন’-এর দিকটা তিনিই সামলান। সঙ্গী রেসকিউ অপারেশন স্পেশ্যালিস্ট সুনীল সামর ও রাজেশ। আর দলের কনিষ্ঠ সদস্য গোবিন্দ। চারতলা থেকে লাফানো, পাঁচিল টপকানো, দড়ি বেয়ে ওঠা তার কাছে ‘বাচ্চোঁ কা খেল।’

সাহায্য পেতে কিছু শর্ত পালন জরুরি। বয়স ও ঠিকানার প্রমাণপত্র চাই, খতিয়ে দেখে কাজে হাত দেন কম্যান্ডোরা। আইনকানুন সব মেনে তবেই। কাজে বিস্তর ঝুঁকি। বিচিত্র পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়। সঞ্জয় বলছিলেন, কলকাতার আলিপুরের হিন্দু ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে প্রেম বিহারের এক মুসলিম মেয়ের। ছেলেপক্ষ রাজি, মেয়ের বাড়ি মারমুখী। মেয়েকে ‘তুলে আনা’র ভার পড়েছিল লাভ কম্যান্ডোদের উপর। বাগডোগরা পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করেছিল গ্রামের লোক। দু’টিতে এখন সুখে সংসার করছে।

হরিয়ানার এক পুলিশকর্তার মেয়ে বাড়িতে বন্দি, যাতে পালাতে না পারে। মেয়ের তখন পরীক্ষা, পাহারা দিয়েই পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গেটে লাঠিধারীরা দাঁড়িয়ে। গোবিন্দ পাঁচিল টপকে জানলার কাচ ভেঙে সেই মেয়েকে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠিয়েছিলেন। লাঠিধারীদের সঙ্গে একা লড়েছিলেন সোনু হিজরা।

উত্তরপ্রদেশের এক সমাজবাদী পার্টির নেতার নাতনি প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে এসে লাভ কম্যান্ডোদের শিবিরে আশ্রয় নিল। নেতার নির্দেশে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ রাতে শিবিরে হানা দিল। পাল্টা কম্যান্ডোরা খবর দিল দিল্লি পুলিশকে। কারণ দিল্লি পুলিশের সঙ্গে তাঁদের দারুণ খাতির। সে বার দিল্লি পুলিশই রুখে দিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে। সম্প্রতি এক গোপন শিবিরে রেজিস্ট্রি হয়েছে বর্ধমানের এক প্রেমিক-প্রেমিকার।

রোজ সকালে প্রার্থনা করেন প্রেমযোদ্ধারা: ‘দুনিয়ার সব প্রেমশত্রু যেন দ্রুত ঘোরতর প্রেমে পড়েন!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE