Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

‘ভারতী’র পাতায় বিবেকানন্দ

বিবেকানন্দ ও সরলা দেবী এই দুই চরিত্রকে এক মলাটে ধরার চেষ্টা করার জন্যেই লেখককে গোড়াতেই সাধুবাদ জানাতে হয়। স্বামীজির পত্রাবলি ও যোগেশচন্দ্র বাগলের টীকা সংবলিত সরলার জীবনের ঝরাপাতা থেকে আমরা জানি, বিবেকানন্দের সঙ্গে সরলার যোগাযোগের সূত্র ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, রবিবাবুর ভাগ্নী, বলে নয়— ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। লেখকও যে এই সূত্র ধরেই এগোতে চান তা তাঁর ভূমিকাতেই পরিষ্কার।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বিবেকানন্দ ও সরলা দেবী এই দুই চরিত্রকে এক মলাটে ধরার চেষ্টা করার জন্যেই লেখককে গোড়াতেই সাধুবাদ জানাতে হয়। স্বামীজির পত্রাবলি ও যোগেশচন্দ্র বাগলের টীকা সংবলিত সরলার জীবনের ঝরাপাতা থেকে আমরা জানি, বিবেকানন্দের সঙ্গে সরলার যোগাযোগের সূত্র ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, রবিবাবুর ভাগ্নী, বলে নয়— ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। লেখকও যে এই সূত্র ধরেই এগোতে চান তা তাঁর ভূমিকাতেই পরিষ্কার। ‘ভারতী’র পাতায় সরলা দেবী সম্পাদক হিসেবে তিন বার বিবেকানন্দকে নিয়ে কলম ধরেন। সেই তিনটি প্রবন্ধ নিয়েই যেন এক রহস্যকাহিনির সূচনা।

সম্পাদক সরলা ঘোষাল ‘ভারতী’-র চৈত্র ১৩০৩ সংখ্যায় (মার্চ ১৮৯৭) বিবেকানন্দকে নিয়ে দু-ভাগে একটি প্রবন্ধ লেখেন: ‘আশা’ ও ‘নিরাশা’; নিরাশ, তিক্ত সম্পাদক তাঁর পাঠককে জানিয়ে দেন আমেরিকার ধর্মমহাসভা মাতিয়ে এলেও এ হেন বিবেকানন্দ স্বদেশের কাজে আসবেন না। পরের সংখ্যাতেই (বৈশাখ ১৩০৪) সম্পাদক ‘প্রত্যাহার’ নামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখে ‘অপরাধের কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত’ করেন। এত শীঘ্র মত বদলের কারণ হিসেবে তিনি বিবেকানন্দের একটি চিঠির উল্লেখ করেন। চিঠিটা কবে কোথা থেকে লেখা, সরলা দেবী তা পাঠককে জানাননি।

‘ভারতী’-তে বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে সরলা তৃতীয় প্রবন্ধটি লেখেন স্বামীজির মৃত্যুর ঠিক পরে, ভাদ্র ১৩০৯ সংখ্যায়। এতেই জানা যায় বিবেকানন্দের সঙ্গে ইতিমধ্যে সম্পাদকের আলাপ ও বেশ কিছু পত্রবিনিময় হয়েছে। সরলা দেবী এই স্মৃতিচারণে স্বামীজির তিনটি পত্র বেছে নেন, যার প্রথমটি ‘প্রত্যাহার’-এর নেপথ্যের চিঠি, যা বিবেকানন্দ লেখেন দার্জিলিঙে বসে ৬ এপ্রিলে, ‘ভারতী’-র মার্চ ১৮৯৭ সংখ্যা হাতে পেয়ে। চিঠির তারিখটা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এই চিঠি হাতে পেয়েই কী দ্রুততায় সম্পাদক বৈশাখী নিবন্ধটি ছাপান। পার্থজিৎ জানিয়েছেন (পৃ ৩৯) মাসের পয়লা তারিখেই ‘ভারতী’ পাঠকের হাতে এসে যেত। দার্জিলিঙ থেকে ৬ তারিখে চিঠি পাঠানর আট দিনের মাথায় প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। স্বামীজিকে বুঝতে তাই আজকের পাঠকের কাছেও এই চিঠি অবশ্যপাঠ্য।

চিঠিগুলি নতুন নয়, বিবেকানন্দের ‘পত্রাবলী’ অথবা ‘বাণী ও রচনা’য় এই তিনটি চিঠিই আছে। বিবেকানন্দ সরলাকে প্রথম চিঠি লেখেন ৬ এপ্রিল ১৮৯৭। ‘ভারতী’-তে প্রকাশিত তিন নম্বর চিঠি থেকে জানা যায় পরের দুই বছরে দুজনে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন। প্রশ্ন জাগে, এগুলির কোনও হদিশ পাওয়া গেছে কি?

এই বইয়ের অন্যতম প্রতিপাদ্য হল বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন সরলাকে বিদেশে নিয়ে যেতে। স্বামীজির এই চিন্তা কি শুধুই মুখের কথা, নাকি সত্যিই বিবেকানন্দের এমন কোনও পরিকল্পনা ছিল? ১৮৯৯-এর এপ্রিলে সরলাকে লেখা চিঠির কয়েক মাস পরেই স্বামীজি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। এই সময় তাঁর কার্যকলাপ অনেকটাই এ যুগের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পক্ষে যেন বিদেশে ‘স্যাবাটিক্যাল’ কাটানো— বক্তৃতা দিয়েছেন, ক্লাস নিয়েছেন প্রায় প্রতি দিন। তা হলে সরলাকে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠল কেন? চিঠি পড়ে মনে হতে পারে স্বামীজি বিদেশে গিয়েছিলেন ভারতের সনাতন ধর্ম প্রচারে, সরলা হয়তো সেই কাজের সহকারী হতেন। কিন্তু স্বামীজির ‘লাইফ অ্যান্ড মিশন’ থেকে জানা যায় তাঁর আসল উদ্দেশ্য কী ছিল। ২৭ জানুয়ারি ১৯০০ প্যাসাডেনা-র শেক্সপিয়ার ক্লাবে বিবেকানন্দ নিজের জীবনের উদ্দেশ্য জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার প্ল্যান হল যেন ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাল খেতে-পরতে পায়। তা হলে, সরলা দেবীকে কেন তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন? বিলেতে না গিয়ে নিবেদিতার মতো সরলাকে কি কলকাতায় ও ভারতে নানা কাজে উদ্বুদ্ধ করা যেত না?

সরলা দেবীর লেখা প্রবন্ধ তিনটি ছাড়াও বইয়ের পরিশিষ্টে জায়গা পেয়েছে বিবেকানন্দকে নিয়ে স্মৃতিচারণা, লেখক স্বামী সদাশিবানন্দ। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’-র আষাঢ়-ভাদ্র ১৩৩১ সংখ্যায়, স্বামীজির প্রয়াণের ঠিক বাইশ বছর পরে। মহাপুরুষ মহারাজের (স্বামী শিবানন্দ) ‘চেলা’ হিসেবে পরিচিত হলেও, এই প্রবন্ধ থেকেই আমরা জানতে পারি সদাশিবানন্দ দীক্ষা পান স্বামীজির কাছেই। এই স্মৃতিচারণও অবশ্য পাঠকের কাছে নতুন নয়। স্বামীজির জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে প্রকাশিত রেমিনিসেন্সেস অব স্বামী বিবেকানন্দ বইটিতে ১৯৬৪-র দ্বিতীয় সংস্করণে যে চারটি প্রবন্ধ জোড়া হয় তার অন্যতম স্বামী সদাশিবানন্দজির লেখা রচনা। এই ইংরেজি রচনাটির প্রথম অর্ধ হল ‘ভারতী’-র প্রবন্ধের দ্বিতীয় ভাগের হুবহু অনুবাদ।

এই বইয়ে এত ছাপার ভুল কেন? প্রথম পাতাতেই (পৃ ২৩) নরেন্দ্রনাথকে ‘১৮৯১’ সালে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে! বিবেকানন্দের বাংলা লেখার বানান ও যতিচিহ্ন ব্যবহার নিয়েও সমস্যা রয়েছে। এই বইয়ে একই চিঠির বয়ান ভিন্ন বানানে ছাপা হয়েছে— সেই ভুল কি ‘ভারতী’-র পাতায়ও ছিল? যেমন, ‘বিলাসভোগসুখেচ্ছা’, ‘কোটি’ দুভাবে লেখা হয়েছে (পৃ ৭৯, ৮৫)। ‘ধন-বল, বুদ্ধি–বল, বিদ্যা-বল’-এ যতিচিহ্ন বদল হয়েছে (পৃ ৫৪, ৯৩)। বিবেকানন্দ নিজে ‘কোটী’ লিখতেন, হাইফেন দিতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE