তৃপ্তি মিত্র এত জোরে বাবার হাতটা চেপে ধরেছিলেন যে, কালশিটে মতো হয়ে গিয়েছিল!
ছবির নাম ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নির্দেশক সাধন সরকার প্রথমে চেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে।
সাবুপিসি রাজি হননি। বাবা ধরে নিয়েছিল, তা হলে ছবি বোধহয় আর হলই না। হঠাৎ শ্যুটিং-এ ডাক পেয়ে ফ্লোরে গিয়ে দেখে, তৃপ্তি মিত্র!
বাবা বেশ ঘাবড়েই যায়। কিন্তু শটে অদ্ভুত কাণ্ড! ক্লোজ শট। তৃপ্তি মিত্রও নির্ঘাত টেনশন করছিলেন। ক্যামেরা চালু হতে ভয়ে খামচে ধরেছিলেন বাবার হাত।
এমন অনেক গল্প বাবার কাছে বড় হয়ে শুনেছি। ছোটবেলায় আমরা দুই ভাই কেউই বাবাকে তেমন করে পাইনি। পরদায়, মঞ্চে যতই হাসিয়ে বেড়াক, বাড়িতে বাবা গম্ভীর। আমরা কে কোন ক্লাসে পড়ি, তাও জানত না। বাজারহাট তো কোন ছার! তার ওপর পান থেকে চুন খসলেও বাবা ঘাবড়ে যেত। কারও রোগজ্বালা হলে যখন বাড়িতে ডাক্তার আসত, টেনশনে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা। আমরা তখন ৬৯এ, চারু অ্যাভিনিউয়ের ভাড়াবাড়িতে। একটা বড় ঘর আর গ্যারেজ ঘরের ওপরে খুপরি একটা ঘর। বড়টায় দাদু, ঠাকুমা, আমি, আমার ভাই। সঙ্গে বাবার এক মামা, তিনি আবার বদ্ধ উন্মাদ। মাটিতে ঢালাও বিছানা করে শুয়ে পড়তাম। দাদু শুধু খাটে। বাবা, মা আর বোন শুতো খুপরি ঘরে।
’৫৮ সাল নাগাদ আমরা চলে গিয়েছিলাম জুবিলি পার্কে। ’৬০-এ ফিরে গেলাম চারু অ্যাভিনিউ। ও পাড়ায় বাবা বাড়ি কিনল। বাসার ঠিকানা হল ৪২এ। এখানেই শেষ দিন পর্যন্ত বাড়িতে কে না আসতেন! উত্তমকুমার, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়। বিকাশ রায় বাবাকে এত শ্রদ্ধা করতেন যে পাশে বসতেন না, বসতেন পায়ের কাছে, মাটিতে। আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তো বাড়ির লোক। সেই কোন ফ্রকবেলায় বাবা সাবুপিসিকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে অভিনয় করাবে বলে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। পরে জানা যায় সাবুপিসিরা সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়। আসতেন মাধবীপিসিও (মুখোপাধ্যায়)।
একটি অনুষ্ঠানে উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মাঝে
শুধু সিনেমারই নয়, খেলার জগতের লোকজনও আসতেন। খেলা বলতে ফুটবল। বাবা ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ। ক্লাইভ রো-তে যখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল’-এ চাকরি করত, ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানেই অফিস ‘কাট’! মেম্বরশিপ গেটে দাঁড়িয়ে গেটও ম্যানেজ করেছে বাবা। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন আর হিমাংশু দত্ত আসতেন মাঠে। শচীনকর্তা বাবার প্রাণ! হাফটাইমে বাবা নিয়ম করে ওঁর হাতে তুলে দিতেন একটা সিগারেট, এক খিলি পান আর এক প্যাকেট চিনে বাদাম।
হাতিবাগান পাড়ায় বাবার একটা গল্প মনে পড়ে। গাড়ি নিয়ে বাবা একদিন হাতিবাগানের স্টারে ‘পরিণীতা’র শো করতে গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড! একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে রাস্তায় ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। চাঁটিও মারছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল বাবার। গাড়ির দরজা খুলে সোজা গিয়ে এক-একজনকে রামধোলাই। কিল, ঘুষি, লাথি। নিমেষে সবাই হাওয়া। সে তো হল, এর পর তুলসী চক্রবর্তী কী বললেন শুনুন, ‘‘আহা, অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’’
বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে বাবা খুব ভক্তি করত। তার অবশ্য একটা অন্যতম কারণ বিক্রমপুরে বাবার কিশোরবেলা। ওই সময় বাবা এক দিকে যেমন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয়পাত্র, অন্য দিকে তেমন স্বদেশিও করত। বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই, রিভলভার নিয়ে পাচার করত। দীনেশ গুপ্তকে ‘গুরু’ মানত। এক সময় বাধ্য হয়েই বন্ধুর গাড়িতে ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে এ পার বাংলায় পালিয়ে আসে বাবা। এমন মানুষের অনন্ত সিংহের প্রতি দুর্বলতা থাকবে না!
অনন্ত সিংহ বাবার ছবির প্রযোজকও হয়েছিলেন। তার প্রথম দুটোই ডাহা ফ্লপ। ‘শেষ পরিচয়’, ‘নতুন প্রভাত’। পরেরটা অবশ্য ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। গল্পটা হলিউডি ছবি থেকে ধার করা। ছবির প্ল্যান-প্রোগ্রাম যখন সারা, তখনই খবর এল, ওই একই গল্প নিয়ে বিকাশ রায়ও ছবি করছেন। তখন পরিচালক আর প্রযোজকের সঙ্গে বসে গল্পটা আমূল বদলে দিয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম বড় কমেডি রোল ‘পাশের বাড়ি’। কমেডি করত বটে, কিন্তু সিরিয়াস রোল করার জন্য ছটফট করত। ওই ‘পাশের বাড়ি’ করার সময়েই বাবা নির্দেশক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিল সিরিয়াস ছবির জন্য আবদার নিয়ে। হল না। সেই কমেডি। ‘পাশের বাড়ি’।
প্রায় বছর ষোলো বাদে যখন ছবিটার হিন্দি ভার্সান ‘পড়োসন’ হচ্ছে, বাবার রোলটা করেছিলেন মেহমুদ। মেহমুদ বাবার পরামর্শ চেয়েছিলেন। এতটাই শ্রদ্ধা! কেষ্ট মুখোপাধ্যায় তো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। মুম্বইয়ের শিল্পীদের এত ভক্তি, অথচ বাবা তেমন কাজই করল না ওখানে। কেবল অফার ছেড়েছে! বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তী। বাবা অবশ্য আমাদের হিন্দি ছবি দেখা বড় একটা পছন্দ করত না। যদিও শুনেছি, নিজে নাকি ‘কিসমত’ দেখেছিল একুশ বার!
গান বলতে বাবা বুঝত নজরুল গীতি। আর গায়ক বলতে শেষ কথা শচীনকর্তা। তবে ছবির গানে শ্যামল মিত্র মাস্ট। আর ওঁর ছবি হলে দু’জন অভিনেতাকে রাখতেই হবে, ছবি বিশ্বাস আর তুলসী চক্রবর্তী। ছবিজেঠুকে গুরুর মতো মাথায় তুলে রাখত। জেঠুও বাবাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। প্রত্যেক দিন হয় আসতেন, নয় ফোন।
‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’। প্রথমে কাস্টিং-এ নাম ছিল অরুন্ধতী দেবী আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্ক্রিপট শুনে অরুন্ধতীদেবী উত্তমকাকুকে করতে অনুরোধ করলেন। কাকুও রাজি। তাঁকে মনে রেখে তিনটে গান লিখে ফেললেন নচিকেতা ঘোষ। একদিন উত্তমকাকু বললেন, ‘‘কয়েকটা জায়গা পাল্টানো দরকার।’’ নির্মাতারা রাজি হলেন না। ব্যস, উত্তমকাকু অ্যাবাউট টার্ন। সরে দাঁড়ালেন অরুন্ধতীদেবীও। শেষে রুমা গুহঠাকুরতা আর বাবা। তখন নচিকেতাকাকু মজা করে বলেছিলেন, ‘‘যাব্বাবা, ভানু থাকবে জানলে আমি গানই লিখতাম না।’’
আরও পড়ুন:গরম তো এসে গেছে...
বাবা লিপ দিল। ছবিও হিট। তখন নচিকাকু বললেন, ‘‘না, না, ভালই লিপ দিয়েছে কিন্তু ভানু।’’
তাতে বাবার কী হাসি!
সিরিয়াস ছবি ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’। বিএল খেমকা ডেকে পাঠালেন। নির্মল দে নির্দেশক। বাবার আর এক গুরু। সিরিয়াস ছবি আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, এই দুটোকে মেলাতে পরিচালক বোধহয় ভরসা পাচ্ছিলেন না। ছ’-সাতটা গান ঢোকালেন। বাবার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু কিচ্ছু বলেনি, গুরু যে! তাই বলে সবখানে যে আপস করেছে, এমন নয়। ‘কাঞ্চনমূল্য’য় যেমন। নির্মল মিত্র ডিরেক্টর। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গল্প। বাবা প্রযোজক। আমরা তখন জুবিলি পার্কে। ও পাড়ায় থাকতেন আর ডি বনসল। ডিসট্রিবিউটর। বাবা প্রযোজক শুনে উনি ছবিতে যোগ দিলেন। কিন্তু প্রথম থেকেই খটামটি লেগেই ছিল। মিন্টু দাশগুপ্ত একটা তরজা গান লিখেছিলেন। বলা হল, ওঁকে দিয়েই ওঁর গানের অংশটায় অভিনয়ও করাতে হবে। বাবা এ দিকে ওই জায়গায় তুলসী চক্রবর্তীকে ভেবে রেখেছিল। হাজার চাপাচাপিতেও বাবাকে কাত করানো গেল না। তুলসীজেঠুই রয়ে গেলেন।
ছবিতে আর একটা কাণ্ডও ঘটেছিল। সুর করেছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এ দিকে নির্মলকাকু বেপাত্তা। খোঁজ, খোঁজ। খবর এল, ‘গঙ্গা’ ছবির গান শিখিয়ে বে়ড়াচ্ছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। সেখানেও তাই, সলিল চৌধুরী সুর করেও হাজিরা দিতে পারছেন না, ভার দেওয়া হয়েছে ওঁকে। শেষে হেমন্তকাকু গান শিখেছিলেন আমার মায়ের কাছে। মা অবশ্য ছোট থেকেই গানের চর্চায়। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র গায়িকা, তবু, হাজার হোক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো!
‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিতে জহর রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
বাবার জীবনে কঠিন বাঁক ষাটের দশকের শেষে। ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় ফাটল। উত্তমকাকু, অনিলকাকুদের (চট্টোপাধ্যায়) বেরিয়ে যাওয়া। পাল্টা সমিতি ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি। খুব কষ্ট পেয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা তখনই। তবু মাথা নোয়ায়নি। ফলে ব্ল্যাক লিস্টেড। যে জন্য বহু দিন কাজ পেত না। এ দিকে সংসার চালাতে হবে যে! তখন যাত্রা একমাত্র সম্বল। কোথায় না কোথায় গেছে তখন যাত্রার জন্য! যে লোকটা নরম বিছানা ছা়ড়া ঘুমোতে পারত না, সে কিনা মাটিতে চাটাই পেতে রাত কাটিয়েছে। ভাঙা বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে। বুকের ওপর পাখা ভেঙে পড়েছে। তবু শক্ত চোয়াল আলগা হতে দেয়নি। ’৭৯ থেকে বাবার শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করল।
’৮৩-র ফেব্রুয়ারি। এত অসুস্থ হল যে, সিএমআরআই-এ ভর্তি করতে হল। সে বার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। মার্চের ৪। আবার অসুস্থ। বুকে অসহ্য ব্যথা। এ বারও ভর্তি না করে উপায় নেই। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝে কার সাধ্যি! সোজা হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠল।
উডল্যান্ডস। রাতও পেরোল না। চলে গেল বাবা। একটা মাত্র দিনও কেউই কিছু করার সুযোগটুকুও পেল না!
অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
ছবি: সমর দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy