বাড়ি থেকে শেষবার যখন মানিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে ছিলেন মাত্র সাতজন মানুষ।
গোটা বাংলাদেশের আর কেউ তার সঙ্গে নেই। ওই সাতজনের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
সেই নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা লিখেছিলেন দীপেন্দ্রনাথ তার ‘নেয়ারের খাট, মেহগনি পালঙ্ক একটি দুটি সন্ধ্যা’ নিবন্ধে।—
‘‘খাট থেকে ধরাধরি করে যখন নামানো হল, তখন দুটি চোখই খোলা। ডানহাতটা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে একবার নাড়লেন। চাউনিতেও তীব্র প্রতিবাদ ছিল। গলায় অস্ফুট শব্দ যার কোনও ভাষা নেই কিন্তু যন্ত্রণা আছে।
সন্ধের সময় খবর পেয়ে যখন পৌঁছেছি, তখনও তাকে সজ্ঞানে দেখিনি। ছোট ঘর, চটের পর্দা দিয়ে কোনওরকমে পার্টিসান করা। ওপাশে বৃদ্ধ বাবা রোগশয্যায় শুয়ে, নীরবে। এপাশে নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুশয্যায় পড়ে। একটা ভাঙা আলমারি, একখানা বুকসেলফ, একটা টেবিল। অজস্র বই আর পত্রপত্রিকা গাদা করা।
পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে নেয়ারের খাটটার একপ্রান্ত শক্ত করে ধরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। দেখছিলাম মানিকবাবুর মুখের এখানে ওখানে দু-একটা কাটা ফাটার চিহ্ন। মাথায় কদিন তেল পড়েনি জানি না, শুকনো চুলগুলো বালির মতো ঝুরঝুরে। পাক ধরেছে, আর সেই আশ্চর্য চোখদুটো বন্ধ।
সমস্ত বাংলাদেশ যে চোখদুটোকে ভয় করত, শ্রদ্ধা করত, সেই চোখজোড়া এখন নামানো।
সেই আশ্চর্য মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আমার কান্না পায়নি। তোলা হল একটা ভাঙা ঝরঝরে অ্যাম্বুলেন্সে। সেই বরানগর থেকে মৌলালী আসার পথে দেখছিলাম, দেশবন্ধুর কৌমার্যব্রতী শিষ্য বিধান রায়ের আলোকোজ্বল প্রাসাদ, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বামপন্থীদের বৃহৎ নির্বাচনী সভা, রাস্তার দেওয়ালে হাঙ্গেরির গোলযোগের ওপর উত্তেজিত পোস্টার, সিনেমা হল-এর সামনে লম্বা লাইন আর পুলিশ। আমি দেখছিলাম। আর দেখছিলাম চোখের সামনে বাংলার অন্যতম সেরা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ভাঙাচোরা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মরে যাচ্ছেন। কী চিকিৎসা হয়েছিল তার প্রমাণ পেয়েছি টেবিলের ওপর রাখা কয়েকটা ওষুধের শিশি দেখে, কী পথ্যি পেয়েছেন তারও প্রমাণ পেয়েছি বৌদির (স্ত্রী কমলা) অসতর্ক কথায়। মৃত্যুকালে বাংলাদেশ তাকে কী মর্যাদা দিল, তার প্রমাণ আমরা বাইরের সাতটা মানুষ। অথচ নাকি লেখক, পাঠক ও কৃষ্টিকলার পৃষ্ঠপোষক সংখ্যায় আমরাই ভারতবর্ষে অগ্রণী।
যে মানুষটাকে খাট থেকে নামাতে গেলেও হার্ট ফেলের সম্ভাবনা সেই তাকে মিউনিসিপ্যালিটির এই ভাঙা অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে যখন তোলা হচ্ছিল মানিক একবার তাকালেন। তার চোখ, গলা আর হাতের মিলিত অভিব্যক্তিতে মনে হল তিনি প্রতিবাদ করছেন। বাড়ি ছেড়ে যেতে কিংবা শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশের সাতটি মানুষের সহায়তা গ্রহণ করতে।
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মেঝেতে স্ট্রেচারের ওপর তিনি শুয়ে, মাথার কাছে আমি। বুকের সামনে ঝুঁকে ডাক্তারবাবু পালস দেখে চলেছেন। বরানগরের দুটি তরুণ শক্তহাতে অক্সিজেনের সিলিন্ডার ধরে আর দরজার সামনে বেঞ্চে বসা বৌদি আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
সামনে ড্রাইভারের পাশে ‘স্বাধীনতা’-র মণি ভট্টাচার্য। ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলা ছিল। অথচ গাড়িটা প্রায় বাতিলের পর্যায়ে পড়ে। থেকে থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে।
সকলে একবার চমকে মানিকবাবুর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন তারপর ছোট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকাচ্ছেন।
আমি হাঁটু গেড়ে বসে দুটো হাত তার কপাল, গাল, কখনও গলার খাঁজে শক্ত করে ছুঁইয়ে রেখেছিলাম। শুশ্রুষার আবেগে নয়, তিনি বেঁচে আছেন,আর শরীরটা এখনও গরম-শুধু এইটুকু উপলব্ধির স্বস্তি পাওয়ার জন্য।
বরাহনগর থেকে মৌলালি, কী দীর্ঘ আর ভয়ঙ্কর সেই যাত্রা। স্পষ্ট বুঝছিলাম তার জ্বরতপ্ত শরীরের উত্তাপ কমছে। আর আহ...আমি বুঝছিলাম তিনি মরে যাচ্ছেন। একটু উত্তাপের জন্য আমি কি প্রার্থনা করব? কিন্তু কার কাছে? কীভাবে? আমি কি চিৎকার করে, চিৎকার করে ডাক্তারবাবুকে ধমকে উঠব? গাড়ি থামিয়ে একটা ইঞ্জেকশন কেন দিচ্ছেন না এই অজুহাতে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মরে যাচ্ছেন অথচ আমার কিছু করার নেই কেন?
আবার গাড়িটা ঝাঁকানি দিল। মনে হল একটা জন্তুর মতো চিৎকার করে ড্রাইভারটাকে গালাগালি দিই। কিন্তু তিনি নির্বাক। আর সত্যিই তো ড্রাইভারের দোষ কোথায়?
মানিক আর হাত নাড়াচ্ছেন না। শুধু মুখটা মাঝেমাঝে হাঁ করছেন নিঃশ্বাস নেওয়ার অস্থির চেষ্টায়। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করছেন,নাঃ, নাঃ! কী না? কেন না? আমি জানি না। কিন্তু হাসপাতাল পৌঁছবার আগেও বারকয়েক উনি নাঃ নাঃ করে উঠেছেন। কানের পাশের শিরায় নাড়ির স্পন্দন অনুভব করা যায়। কিন্তু পাগলের মতো হাতড়েও সেই শিরাটি আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ডাক্তারবাবু গাড়ি থামাতে বললেন। রাস্তার মধ্যে হঠাৎ একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে পড়ায় একজন পথচারী উঁকি দিয়েই চলে গেল। আমার হাসি পাচ্ছে। হিংস্রতা আর কৌতুকভরা হাসি। লোকটা জানেই না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাচ্ছেন। দিকে দিকে এত তুচ্ছ আর যেমন তেমন জীবনের টিকে থাকার ভাঁড়ামি, অথচ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হচ্ছে। লোকটা জানে না। কেউ জানে না! গোটা বাংলার কেউ জানে না মানিক চলে যাচ্ছে।...
ডাক্তারবাবু পালস দেখে অক্সিজেনের চাপ বাড়িয়ে দিলেন। দেখলাম জলের ভেতর বুদবুদ উঠছে। আর ততক্ষণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রশ্বাসের আকুলতায় বুদবুদ হয়ে উঠছেন।
আবার গাড়ি ছাড়ল। আমি বৌদির দিকে মাঝেমাঝে তাকাচ্ছিলাম। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন দৃষ্টি। একদৃষ্টে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। সুভাষ একবার চোরের মতো মানিকবাবুর দিকে তাকালেন। তারপর তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
তার পর শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়। পাঁচমাথার মোড়ের গোল চত্বরটার দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে আমার মনে পড়ল পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ, তার ভেতর এশিয়া একটি মহাদেশ। তার ভেতরে ভারতবর্ষ স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী একটি রাষ্ট্র। তার কোলে শহর কলকাতা— যার ইতিহাস আছে। ইতিহাস আর ঐতিহ্য। আর আমার অসহায় দুটো হাত এই মুহূর্তে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গালে, কপালে, গলায় উত্তাপ খুঁজছে।
গোটা রাস্তায় বার বার বিশ্রী ঝাঁকুনি আর মানিকবাবুর কাতরভাবে নাহ নাহ শুনতে শুনতে একসময় হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম তখন তার মুখও বন্ধ হয়েছে। আর তিনি কথা বলেননি। শুধু মনে আছে এমার্জেন্সির টেবিলে তাঁকে পরীক্ষা করার পর যখন স্ট্রেচারে করে তাকে উডবার্নে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁ চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। মানিকবাবুর কান্না!
আর মনে আছে তারও কিছু পরে উডবার্নের বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী দেয়ালের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘‘দু’দিন আগে যদি আনা যেত তাহলে হয়তো মানুষটা বেঁচেও যেতে পারতেন।’’
মনে হল বউদি সব বুঝতে পারছেন। আমার কাছ থেকে চশমাটা চেয়ে নিলেন। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাপসুদ্ধু চশমাটা তিনি আমাকে রাখতে দিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর আশা ছিল হাসপাতালে মানিকবাবু সেরে উঠবেন। তারপর আবার চশমাটা পরে সেই আশ্চর্য চোখদুটো মেলে তাকাবেন পৃথিবীর দিকে। হয়তো। আমি ঠিক জানি না।
আমাকে জানতে নেই। হয়তো।’’
ঋণ: মানিক স্মরণে (১৯৬৮)
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy