ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের এক ছাপোষা কেরানি একবার বেজায় ফাঁসলেন।
অভিযোগ গুরুতর।
তিনি নাকি এক জাল চেক পাস করিয়ে দিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষ মামলা ঠুকে দিল তার বিরুদ্ধে। সে বেচারার প্রাণান্তকর অবস্থা। সামান্য ক’টা টাকা তো মাইনে, সেই ফরিদপুর থেকে কলকাতায় এসে ছোট একফালি ঘরে ভাইকে নিয়ে ভাড়া থাকেন।
সে ঘর আবার প্রতি বর্ষাকালে এমন ভেসে যায় যে চৌকিতে বসেই খাওয়াদাওয়া সারতে হয়। তার মধ্যে এ কী বিপত্তি!
এইভাবে দিন চলে যার সে কি মামলার খরচ চালাতে পারে? হাজতবাস হয়-হয়, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন দুই বন্ধু।
একজন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যজন সজনীকান্ত দাস।
বেজায় ছুটোছুটি করতে থাকলেন তাঁরা, তাঁদের নিপাট ভালমানুষ বন্ধুটিকে বাঁচাবেন বলে।
এদিকে মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে গড়িয়ে সেসন কোর্টে। মামলা লড়ার টাকা আর নেই। প্রায় টানা এক বছর মামলা চলার পর হাইকোর্টের জজ মিস্টার ব্ল্যঙ্ক এক জব্বর রায় দিলেন। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে বেজায় ধমকে বললেন, ‘‘অভিযুক্ত একজন সাহিত্যিক মানুষ। উনি অন্য জগতে বিচরণ করেন। তাঁর তো ভুল হতেই পারে। আসল দোষ ব্যাঙ্কের। তারা অমন মানুষকে ওই কাজে নিলেন কেন?’’
এই রায়েই বেকসুর ছাড়া পেলেন অভিযুক্ত নরেন্দ্রনাথ মিত্র। ফিরে পেলেন চাকরি, তবে জয়েন করেই রেজিগনেশন।
আবার ওই কাজ! কক্ষনও না। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও না।
রোজগারের ভাগ্য গোড়া থেকেই বেশ খারাপ।
১৯৩০ সালের মাঝামাঝির কথা। সেই সময় অনেক ছেলেই খরচ বাঁচানোর জন্য রেসিডেনশিয়াল টিউটর হিসেবে এদিক ওদিক থাকতেন। যে ছাত্র বা ছাত্রীকে দু’বেলা পড়াতে হবে সেই বাড়িতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
নরেন্দ্রনাথও চেষ্টা করলেন তেমন কিছু একটা করার। কিন্তু স্বভাবে এমনই মুখচোরা যে ছাত্ররা কেউ কথাই শোনে না।
ফলে কোথাও আর ‘রেসিডেন্ট’ হয়ে ওঠা গেল না। একবার সুযোগ পেলেন এক জজসাহেবের বাড়িতে থেকে তার ছেলেকে পড়ানোর। সেই কাজটিও কয়েক দিন বাদে চলে গেল। সেই যাওয়ারও অভিযোগটি বেশ অদ্ভুত।
নরেন্দ্রনাথের পাশবালিশ নিয়ে শোওয়ার অভ্যাস জজ গিন্নির নাকি পছন্দ হয়নি। তাই, একমাত্র সেই কারণেই মাস্টার বিদায়। যে মাস্টার বালিশ জড়িয়ে ঘুমোয় সে নির্ঘাত আলসে, সে আবার পড়াবে কী?
সরকারি চাকরিও ছাড়তে হয়েছে শহরে বোম পড়ার ভয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। যুদ্ধের বাজারে অনেকেই চাকরি পেল। নরেন্দ্রনাথও পেলেন। ভাবলেন, এবার বুঝি অভাব মিটল।
অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কাজ। ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য যেসব বালতি আসত, সেগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, তা টিপেটুপে চেক করতে হত। এই ছিল সারাদিনের কাজ। কিন্তু সেই চাকরিও কপালে সইল না।
কলকাতায় শুরু হল বোমা পড়া। অগত্যা তল্পিতল্পা আর মন খারাপ নিয়ে আবার দেশের বাড়ি।
পিতৃদেব মহেন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘খবরদার! তোমাকে আর মাথায় বোম নিয়ে চাকরি করতে হবে না।’’
বরাবরই পল্টুকে (নরেন্দ্রনাথের ডাকনাম) নিয়ে চিন্তা ছিল মহেন্দ্রনাথের।
চিন্তা হওয়াই স্বভাবিক। নিজে ছিলেন বিশালদেহী সুপুরুষ, একা হাতে সব কাজ করে ফেলতে পারতেন। বিরাট সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল অনেক অল্প বয়েসে। পাকা সংসারী লোক।
অন্যদিকে নরেন্দ্রনাথ চেহারায়-কাজে বাবার পুরো বিপরীত। খাটো চেহারা, তায় মুখে টুঁ শব্দটি নেই। কাজকর্মেও একেবারে আনাড়ি। চাল কিনে আনতে বললে বাতাসা কিনে বাড়ি ফেরেন।
সঙ্গে স্ত্রী
আত্মকথায় নরেন্দ্রনাথ নিজেই লিখছেন, ‘‘আমি বাবার মতো হইনি, এ সম্বন্ধে ছেলেবেলা থেকেই আমি সচেতন ছিলাম। বাবা ছিলেন আটপিঠে মানুষ। দরকার হলে যেমন কোদাল কুড়ুল চালাতে পারতেন, তেমনি কলম চালাতেও তাঁর ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু গাঁয়ের ছেলে হয়েও আমি না পারি গাছে উঠতে, না পারি নৌকা বাইতে। আরও এমন হাজার কাজ পারি না, যা আমার ছোটভাই পারে। যা আমার সমবয়েসিরা এমনকী কমবয়েসিরাও পারে। বাবা যেমন সামাজিক মানুষ, বলতে-কইতে ওস্তাদ। আমি ঠিক সেই পরিমাণে লাজুক, মুখচোরা, কুনো স্বভাবের। পিতৃদেব মাঝেমাঝেই হতাশ গলায় বলতেন, ‘পল্টুটা যে কোনও কাজই পারে না, ওর যে কী গতি হবে!’ সান্ত্বনা দিতেন ‘পল্টুর মা’। ‘পারবে দেখো ঠিক পারবে। চিরকাল কি আর এমনটি থাকবে আমাদের পল্টু’।’’
এই ‘পল্টুর মা’ কিন্তু নরেন্দ্রনাথের জন্মদাত্রী ছিলেন না। আপন মা গত হয়েছিলেন যখন নরেন্দ্রনাথের বয়স মোটে চার।
মহেন্দ্রনাথের দুই স্ত্রী। মা মারা যাওয়ার পর মহেন্দ্রনাথের প্রথম স্ত্রীর কাছে বড় হন নরেন্দ্রনাথ। ভাই ধীরেন্দ্রনাথেরও শৈশব কেটেছে তাঁরই কোলেপিঠে। জন্মদাত্রী মায়ের অভাব কোনও কালে টের পেতে দেননি ওদের ‘বড়মা’।
•
একই ঘরের মধ্যে দুই উঠতি সাহিত্যিক গল্প লিখছেন। ঘরে চেয়ার -টেবিলের কোনও বালাই নেই। দুজনেই যে যার তক্তপোশে।
একজন উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কলম চালাচ্ছেন, আর অন্যজন বাবু হয়ে বসে সামনে টিনের বাক্স রেখে তার ওপর খাতা রেখে লিখছেন। উঁহু, তিনি নিঃশব্দে নয়, বরং যে লাইনটি লিখবেন তা বেশ শব্দ করে আগে আউড়ে নিচ্ছেন। তারপর লিখছেন।
প্রথমজন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়জন নরেন্দ্রনাথ। কোনও কালেই নিঃশব্দে লিখতে পারতেন না নরেন্দ্রনাথ।
তখন শোভাবাজারের এক মেসে একটি ঘরে পাঁচজন। নরেন্দ্রনাথ, ভাই ধীরেন্দ্রনাথ, বন্ধু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর বাকি দুই বোর্ডার এক গেঞ্জিকলের শ্রমিক। মাথাপিছু মাসিক ভাড়া দুইটাকা।
কিছু দিন আগেই ভাইকে কলকাতার কলেজে পড়াবেন বলে নিয়ে এসেছেন। এদিকে নিজের আয় বলতে মাত্র দুটি টিউশনির টাকা। নিজেরই চলে না। কিন্তু তাই বলে ভাইকে কিছুতেই মফস্সল কলেজে বি এ পড়াবেন না।— ‘‘তুই চলে আয়, কলকাতার কলেজে পড়বি। দায়িত্ব আমার,’’ বলে ভাইকে ডেকে নিলেন।
মেসে খাওয়া-দাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। টানাটানির সংসারে পাইস হোটেলে দু’আনায় দুইবেলা ডিম ভাত খেয়ে দিনের পর দিন চলত। তবে নারায়ণ কিংবা নরেন্দ্র যারই গল্প লেখার টাকা যে দিন আসত, সেদিন এক এলাহি ব্যাপার। তিনজনে মিলে রূপবাণী রেস্টুরেন্টে ফাউল কাটলেট আর টকি শো হাউজে তিন আনার সিটে গ্যারি কুপারের ছবি।
তা ছাড়া মাঝেমাঝেই ওই মেসের ঘরেই বসত সাহিত্যের আসর। দুই লেখকেরই বন্ধুরা আসতেন। নীচের শ্যামসুন্দর কেবিন থেকে আসত এক পয়সা কাপের চা।
অনেক রাত অবধি চলত সাহিত্য নিয়ে ধুন্ধুমার চর্চা। তখন বেচারি ওই দু’জন গেঞ্জিকলের কর্মীর মুখগুলো শুধু দেখতে হয়। বেজার মুখে সরস্বতীর অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় কি!
গল্পলেখক হিসেবে অল্পস্বল্প নাম হতে শুরু করেছেম তখন। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’ পড়ে দেশ-এর দফতর থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন, ‘‘আপনার গল্প আমাদের ভাল লেগেছে। আপনি আরও গল্প পাঠান।’’
আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়-র সম্পাদক মন্মথনাথ সান্যালও প্রায় একই রকম চিঠি দিয়েছেন। উৎসাহে লিখে চলেছেন নরেন্দ্রনাথ।
ঠিক তখনই বাড়ি থেকে চাপ এল বিয়ে করতে হবে।
কান্নাকাটি অবস্থা নরেন্দ্রনাথের। কিছুতেই বিয়ে করবেন না। নিজেরই চলে না, বউকে খাওয়াবে কী?
কিন্তু শেষমেশ করতেই হল।
যদিও বউ রইল ফরিদপুরে দেশের বাড়িতে আর বর কলকাতায়। ভাইয়ের সঙ্গে।
কিন্তু সে আর কত দিন?
বউ শোভনাকে নিয়ে কলকাতায় আসতেই হল একসময়। দুই ছেলেও হল তার পর। আর চলতে লাগল একের পর এক বাসা বদল।
ছোটভাই ধীরেন্দ্রনাথও বিয়ে করে সস্ত্রীক দাদার সঙ্গে থাকে। কখনও বস্তিতে টালির ঘর, তো কখনও দেড়খানা কোঠা ঘরে, সবাই মিলে।
সে ঘর আবার এমন ছোট যে, ছোট একটা খাট পাতলেও, একটা চেয়ার রাখারও জায়গা নেই।
একবার কিছু দিনের জন্য নিমতলার কাঠগুদামের কাঠের ঘরেও থাকতে হয়েছে। এমন দিনও গেছে, সকাল বিকেল দুইবেলা চাকরি করতে হয়েছে সংসারের খরচ মেটাতে।
তার মধ্যেও লেখা কিন্তু থামাননি।
‘রস’ গল্পটি যখন লিখছেন তখন থাকতেন ব্রজদুলাল স্ট্রিটের একটি ঘরে। বর্ষাকালে সেই ঘরে এক হাঁটু জল। ওই থই থই ঘর ভর্তি নোংরা জলে তক্তপোশের ওপর বসে লিখেছেন একের পর এক কালজয়ী লেখা।
•
‘তোমাকে বাসি ভাল একথা ক্ষণে ক্ষণে/ বলিব তোমা ভাবি সদাই মনে মনে/ বলিতে যবে যাই কথা না খুঁজে পাই/ হতাশ হয়ে ফিরি আপন গৃহকোণে’। ‘মূক’ নামের মোট ষোলো লাইনের এই কবিতাটি প্রকাশ পেল আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে দেশ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায়।
কবির নাম নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
হ্যাঁ, কাহিনিকার নরেন্দ্রনাথের এত তো পাঠক, কিন্তু ক’জনই জানেন তাঁর কবিতার কথা? অথচ প্রায় টানা কুড়ি বছর ধরে কবিতা লিখেছেন তিনি।
‘নিরিবিলি’ নামে নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন। আর সেই বইয়ের আলোচনা লিখলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু।
‘কবিতা’ পত্রিকায় কী লিখলেন বুদ্ধদেব?
‘‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের পাঠক সংখ্যা আজ বিপুল, কিন্তু এ-বইখানা পড়ে (বা দেখে) আজকের দিনে কম পাঠকেরই সন্দেহ হবে যে এর প্রণেতা ও তঁদের প্রিয় কথাশিল্পী একই ব্যক্তি।’’
প্রথম থেকেই নরেন্দ্রনাথকে কবিতা লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন বুদ্ধদেব বসু। কবিতা পত্রিকায় অনেক কবিতা ছাপিয়েছিলেন তিনি।
শুধু তাই নয়, নরেন্দ্রনাথ কেন কবি না হয়ে গদ্যশিল্পী হলেন তাই নিয়ে তাঁর বেজায় আফসোসও গোপন করেননি।
না, আর কোনও কবিতার বই প্রকাশ করেননি নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু নিজেই বলতেন, ‘‘কবিতার মধ্যে যে ভাবে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে ঢেলে দেওয়া যায়, তেমন আর কোনও রচনায় যায় না।’’
‘সুইজারল্যান্ড’ কবিতায় মাত্র ছয় লাইনে নিজের জীবনকে লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘মেসের একতলা স্যাঁতসেতে ঘর/ জীর্ণ তক্তপোশে সহস্র ছারপোকা/ বাতাসে নর্দমার ঘ্রাণ।/ উবু হয়ে বসে দেখি এক পয়সার মুড়ির ঠোঙাতে/ ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড।’’
•
স্ত্রী শোভনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সব কথা ভাগ করে নিতেন তাঁর সঙ্গে। মেয়েদের সেজে গুজে থাকাটা খুব পছন্দের ছিল নরেন্দ্রনাথের। মাঝেমাঝেই স্ত্রীর জন্য নিয়ে আসতেন খোঁপায় বাঁধার জন্য ফুল, ফুলের মালা।
একবার হল কী, বেশ কিছু দিন ধরে কোনও লেখা আসছে না। রাইটার্স ব্লক হলে যা হয়! ভীষণ ভীষণ মন খারাপ। স্ত্রীকে ডাকলেন।
‘‘শোভনা আমি আর লিখতে পারছি না।’’
‘‘পারবে ঠিক পারবে।’’
তাই-ই হল। একদিন সত্যিসত্যিই আবার লেখা ফিরে এল। লিখতে শুরু করে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ।
স্ত্রীকে সব কথা বলা চাই। মাঝেমাঝেই লেখার টেবিলের কাছে শোভনাকে ডেকে নিয়ে বলতেন, ‘‘এই দেখো সত্যি সত্যি একটা উপন্যাসের ছক গেঁথেছি। লিখতে খুব ভাল লাগছে, জানো। বলা যায় না হয়তো এটা একটা গ্রেট উপন্যাস হয়ে যেতে পারে।’’
এমন জোর দিয়ে লেখার বিষয় আগে কোনও দিন শোনেননি শোভনা।
ভারী খুশি হয়ে বলেন, ‘‘বেশ তো! তাহলে লেখো না। এবার বরং পুজোর লেখা বন্ধ রেখে এই উপন্যাসটিই শেষ করো।’’
তাই শুনে হাঁ হাঁ করে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ, ‘‘বলো কী! পুজোর লেখা লিখব না, তাই কখনও হয়! পুজোর লেখার আনন্দই যে আলাদা। তোমরা যেমন পুজোয় নতুন জামাকাপড় পরে ,অন্যকে দিয়ে আনন্দ পাও, আমরা লেখকরা তেমনি পুজোয় নতুন লেখা পাঠকদের দিয়ে আনন্দ পাই।’’
আরেকদিন বললেন, ‘‘শোভনা, আমার আত্মজীবনী লিখতে ইচ্ছে করছে। বেশ মোটা করে একটা নিজের কথা লেখার ইচ্ছে,’’ বলেই মুচকি হেসে আবার বললেন, ‘‘না না মন খারাপ কোরো না। ওতে তুমিও থাকবে অনেকটা জুড়ে।’’
শোভনাও পালটা উত্তর দিলেন, ‘‘নিজেই লিখবে? আমার তো ইচ্ছে ছিল তোমাকে নিয়ে একটা মস্ত লেখা লিখব। তোমার যা অদ্ভুত স্বভাব। জমিয়ে লিখতে পারলে পাঠকরা খুব মজা পাবে।’’
‘‘বেশ তো তাহলে লিখো। তবে শুধু ত্রুটির কথাই লিখো না। একটু বানিয়ে বানিয়েই না হয় নিজের স্বামীর গুণের কথাও লিখো।’’
তারপর দুজনের সে কী হাসি!
আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পরে অভাব আর অনিশ্চিত জীবন শেষ হল।
পাইকপাড়ায় চলে এলেন সপরিবার। জীবনে অনেক জায়গায় বহু কষ্টে কাটিয়েছেন, তাই বুঝি শখ হল নিজের একটা বাড়ি বানাবার।
পাবলিশার্সদের কাছ থেকে টাকা ধার করে জমি কিনলেন মেন রাস্তার ওপর।
তারপর দোতলা বাড়ি করলেন। তিনতলা করারও শখ হল। ভাই বললেন, ‘‘কী হবে দাদা তিনতলা করে?’’
‘‘থাক না। রিটায়ার করবার পর না হয় ভাড়া দিয়ে দেব।’’
আসলে হয়তো মনের কথা অন্য ছিল। কখনও খুপচি বস্তি, কিংবা মেসের একচিলতে ঘরে দিনের পর দিন কাটানোর যন্ত্রণা ভুলতে চেয়েছিলেন প্রয়োজনের বেশি ঘর করে।
তিনতলার কাঠামোও শুরু হল। হেড রাজমিস্ত্রিকে ডেকে বললেন, ‘‘জয়নুল, আমার কাজটা ভাল করে কোরো তাহলে তোমায় নিয়ে ভাল গল্প লিখব। আমার গল্পের মধ্যে তুমি বেঁচে থাকবে।’’
মাথায় শুধু চিন্তা ঘুরপাক খেত রিটায়ারমেন্টের পর কী করব? কীভাবে চলবে?
তাই কখনও পাড়ায় লাইব্রেরি তৈরির জন্য মাতেন, তো কখনও তিনতলা তৈরির কথা ভাবেন, আবার কখনও আত্মজীবনী লেখার ভাবনা চেপে বসত মাথায়।
ভাইকে ডেকে বললেন, ‘‘বুঝলি আজকাল লেখার স্পিড বড় কমে গেছে। লিখতে কষ্ট হয়। কিন্তু না লিখেও তো থাকতে পারি না। আর দু’বছর পর রিটায়ার করব। পাড়ার লাইব্রেরিটা যদি দাঁড় করাতে পারি তাহলে একটু বসার জায়গা হবে আর কী!’’
আবার কখনও বলে উঠতেন, ‘‘ছেলেরা বড় হল, নাতিনাতনিও দেখলাম। এবার চলে গেলেই হয়।’’
ভাই বুঝতেন, এ’কথা দাদার মনের কথা নয়, কারণ ক’দিন আগেই তো দিস্তা দিস্তা সাদা কাগজ আনিয়েছেন মস্ত এক উপন্যাস লিখবেন বলে।
তারপর রোজের মতো সেদিনও সকাল হয়েছে। পুজোর লেখা চলছে পুরোদমে। সকালে একটি গল্প শেষ করে অফিস গেলেন নরেন্দ্রনাথ।
বিকেলের দিকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন। কেমন যেন একটু অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু চিরকালের মুখচোরা যে! কাউকে কিছুই বললেন না।
বাড়িতে গানের আসর বসেছে। অনেক বন্ধুবান্ধব। আড্ডা। সকলের সঙ্গে বসে খেলেনও। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না।
এই করতে করতে মাঝরাত।
কষ্টটা বাড়ছে.. বাড়ছে...
চেনা জানা কেউ মারা গেলে আফসোস করে নরেন্দ্রনাথ বলতেন, ‘‘জীবন এইরকমই। চলতে চলতে হঠাৎ কখন থেমে যায়। সবকিছু অসমাপ্ত পড়ে থাকে।’’
১৪ সেপ্টেম্বর সেই গভীর রাত। সত্যি সত্যিই হঠাৎ করেই থেমে গেলেন নরেন্দ্রনাথ।
পড়ে রইল তাঁর অধরা আত্মজীবনী!
ঋণ: প্রসঙ্গ নরেন্দ্রনাথ মিত্র, ভাঙা আবহমান- নরেন্দ্রনাথ মিত্র সংখ্যা, রবি-রসের বশে, অভিজিৎ মিত্র, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি, কলকাতা লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy