Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

তিন পয়েন্ট ছাড়ার জন্য চাপ দিতে আমার মেয়েকে অপহরণ করা হয়

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ দ্বাদশ কিস্তি। সমর্থকদের হিংসাত্মক আচরণ, ক্লাব কর্তাদের চরম দুর্ব্যবহার, মিডিয়ার সীমাহীন ঔদ্ধত্য সামলানোর কঠিনতম দিনের ঘটনাবহুল বর্ণনা।মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ দ্বাদশ কিস্তি। সমর্থকদের হিংসাত্মক আচরণ, ক্লাব কর্তাদের চরম দুর্ব্যবহার, মিডিয়ার সীমাহীন ঔদ্ধত্য সামলানোর কঠিনতম দিনের ঘটনাবহুল বর্ণনা।

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

দর্শক-সমর্থকদের অশ্রাব্য গালিগালাজ। ক্লাবকর্তাদের রক্তচক্ষু। মিডিয়ার তীব্র সমালোচনা। নিন্দেমন্দ-কটাক্ষ। এসবই যে কোনও কোচের কপালেই লেখা থাকে। রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

কিন্তু নিজের দলের রেকর্ড ছোঁয়ার বছরে কোনও বিশেষ ম্যাচের আগে কোচের সন্তান কিডন্যাপ্‌ড হচ্ছে!

কোচের বৌ ম্যাচ দেখতে গেলে মাঠে স্বামীর দলের সমর্থকদের ছোড়া ঢিলে মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি ঘটছে!

ক্লাস থ্রি-তে পড়া নিজের মেয়ে দুরারোগ্য রোগে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও কোচকে খেলার দিন মাঠে সামান্য দেরিতে আসার অপরাধে ক্লাবকর্তার ধ্যাতানি খেতে হচ্ছে!

কোচকে টাইট দিতে তার নামে ঐতিহ্যশালী ইংরেজি দৈনিকের ক্রিকেট-খেলোয়াড়-টার্নড্-ফুটবল রিপোর্টারের ভিজিল্যান্স পর্যন্ত করে দেওয়া!

এ সব শুধু এ দেশে নয়, বোধহয় ফুটবলবিশ্বেই একমাত্র আমার কোচিং কেরিয়ারে ঘটেছে!

অথচ সেই বাহাত্তরে আমার প্রথম বড় ক্লাবের কোচ হয়ে ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্র্যাকটিস শুরুর দিন গোটা গ্যালারি দর্শকে ঠাসা! আজকাল ইস্টবেঙ্গল অথবা মোহনবাগানের ম্যাচেও অত দর্শক মাঠে আসে না!

৭৭-এর বড় ম্যাচে উত্তেজনায় ঠাসা গ্যালারি।

সে দিন সাড়ে সাত আনা থেকে শুরু করে দশ আনা-র গ্যালারির চেয়েও বেশি ভিড় মেম্বারশিপ স্ট্যান্ডে। অত সকালেও হাজার হাজার ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার পিকে-র ট্রেনিং করানো দেখতে মাঠে হাজির! আবার পাক্কা তিন মাস টানা প্র্যাকটিসের পর লিগের প্রথম ম্যাচের হাফটাইমেই ইস্টবেঙ্গল মাঠে আমার বাপ-মা উদ্ধার হয়েছে!

আসলে ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিয়ে আমি একটা কথা সাফ অফিশিয়ালদের বলে দিয়েছিলাম। লিগের আগে আমার দল একটাও প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে না। নো ভাড়া ম্যাচ...নো ভাড়াটে টুর্নামেন্ট! ব্যাস, এই যেই বলা, হা হা করে তেড়ে এলেন কয়েকজন ক্লাবকর্তা।

“ভাড়া ম্যাচ কারে কইসেন! ভাড়াটে টুর্নামেন্টের আপনি কী বোজেন? ক্লাবে কোথ্বিকা টাকা আসব তার কী জানেন মশাই আপনি?” গনগনে মেজাজে বলেছিলেন ডাক্তার দাসের কয়েক জন সঙ্গী। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। তবে সেবার লিগের প্রথম ম্যাচেই যখন ভ্রাতৃ সঙ্ঘের গোলে বল ঢোকাতে আমার ছেলেদের পাগল হওয়ার জোগাড়, তখন আমিও মনে মনে প্রমাদ গুনছি।

রেফারির হাফটাইমের বাঁশি বেজে গেল। তবু গোল নেই। টিম নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছি। এক ক্লাব সদস্য গ্যালারির ওপর থেকে আমাকে চেঁচিয়ে বললেন, “ওই যে যাচ্ছে বরাহনন্দন!” নোংরা গালাগালও কী ভদ্র ভাষায় দেওয়া যায়, সেই প্রথম জেনেছিলাম আমি।

তার পর তো ড্রেসিংরুমে ফুটবল সেক্রেটারি অজয় শ্রীমানির কাঁদো-কাঁদো অবস্থা! “প্রদীপদা, যে ভাবে হোক গোলের রাস্তা বাতলান ছেলেদের। নয়তো ম্যাচের শেষে মেম্বার-সাপোর্টারদের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে মরে যাব। সিজনের প্রথম ম্যাচেই আটকে গেলে আর দেখতে হবে না...’ বলেই চলেছে ঘটির ছেলে শ্রীমানি।

সেবার ইস্টবেঙ্গলে এমনই তাত্‌পর্যের ব্যাপার যে, কোচ ঘটি, ফুটবল সেক্রেটারিও ঘটি। তাই হাফটাইমের পর যখন টিম নিয়ে মাঠে আবার ঢুকছি, গ্যালারি থেকে “গোল আসব কোথ্বিকা? আমাগো হতচ্ছাড়া কোচটা ঘটি, ফুটবল সেক্রেটারিও ঘটি!” টিটকিরি শুনে অত চাপের মুখেও মনে মনে মজা পেয়েছিলাম। প্রিয় ক্লাবের জয় দেখতে কী প্রচণ্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন হন সমর্থকেরা!

সারা বিশ্ব জুড়েই এই ট্রেন্ড। অত শিক্ষিত ব্রিটিশরা পর্যন্ত ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচে সারাক্ষণ প্রার্থনা সঙ্গীত গায় গ্যালারিতে। গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচের আগে ওদের মতো করে পুজোআচ্চা করে। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের এল ক্লাসিকো যুদ্ধে নাকি স্প্যানিশরা নিজের নিজের প্রিয় ক্লাবের ওপর থেকে সব অশুভ তাড়াতে ভূতপ্রেতের পুজোটুজোও করে থাকে!

যা হোক, ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে প্রথম ম্যাচটাই কোনও ক্রমে উতরেছিলাম একেবারে শেষ দিকে মোহন সিংহের একটা দুর্দান্ত গোলে।

তার অনেক পরে সে দিনের ‘বরাহনন্দন’ বলা সেই ইস্টবেঙ্গল সদস্যকে চিনেছিলাম। ভদ্রলোক শিয়ালদায় নামী রেস্টুরেন্টের মালিক। ইস্টবেঙ্গলে তাঁর মেম্বারশিপ কার্ড নম্বর ২৫। বুঝুন, কত দিনের পুরনো মেম্বার। অথচ তাঁর মুখে অমন ‘অমৃতবচন’!

মজার ব্যাপার, পরের দিকে বছরের পর বছর আমার কোচিংয়ে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যে সেই বুড়ো ভদ্রলোক আমার বিরাট ফ্যান হয়ে উঠেছিলেন। এতটাই যে, ওঁর রেস্টুরেন্টের যেটা স্পেশাল আইটেম, সেই ডিমের ডেভিলের নাম দিয়েছিলেন ‘পিকে’জ ডেভিল’! যার জন্যই কি না জানি না, সত্তরের দশকের প্রথম হাফে ইস্টবেঙ্গলকে কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে বারকয়েক ‘পিকে’জ ডেভিলস’ লেখা হয়েছে।

আবার সেই কাগজেরই বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক পরের দিকে উঠতে-বসতে আমার সমালোচনা করেছেন। বিদ্রুপ করেছেন প্রায় সব ম্যাচের পর। একমাত্র বোধহয় বড় ম্যাচ পাঁচ গোলে জেতার পরের দিনের কাগজে ছাড়া!

কী ইস্টবেঙ্গল আর কী মোহনবাগান, আমার কোচিংয়ে টিম জিতুক বা হারুক, ওই রিপোর্টারের যেন কাজই ছিল, তাঁর কাগজের অফিসে বিদেশি ফুটবলের বইপত্তর ঘেঁটেঘুঁটে নিজের রিপোর্টে প্রমাণের চেষ্টা করা, সে দিনের ম্যাচে আমার স্ট্র্যাটেজি কোনও মৌলিক ব্যাপার নয়। অমুক সালে, তমুক কোচ, অমুক খেলায় এই ফর্মেশনে খেলিয়েছিলেন। আমি নাকি সেখান থেকে টুকেছি। এখন অবসরোত্তর সেই প্রৌঢ় সাংবাদিককে কে বোঝাবে, শুধু ফুটবল নয়, গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটার, উপন্যাস-কবিতা, চিত্রকলা... মনুষ্য জীবনের প্রায় সব পারফমির্ং আর্টেই এক জনের সৃষ্টিতে কোনও কোনও সময় তাঁর পেশার কোনও পূর্বসূরির কীর্তির ছাপ জান্তে বা অজান্তে পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক। তাতে সেই সৃষ্টিরই স্ট্যান্ডার্ড বাড়ে।

আসলে ইংরেজিতে যাঁরাই যে বিষয়েই লেখেন, আমাদের পোড়া দেশের মানুষ বোধহয় ভাবে, ওই রে! ইংরেজিতে লিখছে, মানে লোকটা সব জানে! শেষমেশ ওই ইংরেজিতে লেখা সাংবাদিক আমাকে বাগে আনতে না পেরে আমার নামে ভিজিল্যান্স পর্যন্ত করেছিলেন! যদিও তাতে আমার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল বই কমেনি!

মিডিয়ার সমালোচনার কথা যখন বলছি, তখন দুই জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের দুই অভিজ্ঞ ফুটবল সাংবাদিকের কথাও বলতে হয়। তাঁদের এক জন আমাকে যত না গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন, তার চেয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন বেশি।

এক বার তিনি লিখলেন, আমি নাকি রেলওয়ে বোর্ডের অন্যতম শীর্ষকর্তা ফাল্গুনী মতিলালকে তেল দিয়ে ইস্টার্ন রেলের ডেপুটি সেক্রেটারি হয়েছি। তর্কের খাতিরে যদি সেটাকে সত্যিও ধরে নিই, তা হলেও ওই ঘটনার সঙ্গে কোচ পিকে-র পারফরম্যান্সের সামান্যতমও সম্পর্ক কোথায়?

’৭৭-এ লিগ ফুটবলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ শুরুর মুহূর্তে।

অন্য বাংলা কাগজের নামী ফুটবল রিপোর্টার আবার অনেক বার চেষ্টা করেছেন কোনও না কোনও ফুটবলারের সঙ্গে আমার ঝামেলা লাগানোর। আশির দশকের মাঝামাঝি ইস্টবেঙ্গলের শ্রীলঙ্কা ট্যুরে মনোরঞ্জন কোনও ন্যায্য কারণ ছাড়া যেতে চাইল না। আমি বাধ্য হয়ে স্টপারে আনকোরা প্লেয়ার খেলিয়েও চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরলাম।

তার পর ময়দানে ইস্টবেঙ্গলের একটা ম্যাচে কোনও কারণে মনোরঞ্জনকে বাদ দিয়েছি বোধহয়। ব্যস, সেই সাংবাদিক পরের দিনের কাগজে লিখে দিলেন, মনোরঞ্জনের ওপর পুরনো আক্রোশ মেটাতে পিকে ওকে বাদ দিয়েছে। মনাও তাতে তার পর দিনকয়েক প্র্যাকটিসে মুখ হাঁড়ি করে থাকল। যার কোনও ভিত্তি বা কারণ, কোনওটাই ছিল না।

এগুলোকে সামলানোর সেরা উপায় হল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা। তুমি একটুও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছ কী পরের দিন রিপোর্টারের লেখায় তোমার নামে নিন্দেমন্দ আগের চেয়েও শত গুণ বেড়ে যাবে। তার চেয়ে চুপ থাকো। মিডিয়া নিজেরাই লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে একটা সময় থেমে যাবে।

যেমন ক্রিকেটে প্রাক্তন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান করেছে। বর্তমান ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি করে। কিংবা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার করে থাকে। এই যে এত বছর ধরে আর্সেনাল কোনও বড় ট্রফি জিততে পারছে না, ওয়েঙ্গারকে কেউ হটাতে পেরেছে?

মাঠের যাবতীয় দিকের সব সমালোচনা ম্যানেজ করার ব্যাপারে আমার আর একটা বিরাট শক্তি ছিল আমার স্ত্রী আরতি। যে কোনও ম্যাচে, বিশেষ করে বড় ম্যাচের দিন আর খেলার পরের দিন একটাও কাগজ আমাকে পড়তে দিত না ও।

দু’তিন দিন পরে, যখন মানসিক ভাবে সেই বড় ম্য্যাচের ব্যাপারে আমার পুরোপুরি কুলিং ডাউন হয়ে গিয়েছে, তখন আরতিই প্রতিটা কাগজে বেরনো সেই ম্যাচের সব রিপোর্ট আমাকে পড়িয়ে শোনাত। যাতে আমি আবার আপ-টু-ডেটও থাকতে পারি।

এই আরতিই মোহনবাগান মাঠে সমর্থকদের হাতে কী ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটার থেকে রক্ষা পেয়েছিল! তাতেও অবশ্য মাথা ফাটিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল ওকে।

সাতাত্তরে লিগের বড় ম্যাচে মোহনবাগান হটফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলের কাছে দু’গোলে হেরেছিল। আমার তো তখন মোহনবাগান মাঠে টেকাই দায়! আরতি বলল, চলো তো, পরের ম্যাচটায় গিয়ে দেখি, সমর্থকরা তোমায় কী ‘অভ্যর্থনা’ দেয়!

কিন্তু আরতিকে মেম্বারশিপ গ্যালারিতে চিনে ফেলতেই কয়েকশো মোহনবাগান সমর্থক ঢিল মারতে শুরু করে দেয়। এখনও মনে আছে, সে দিন আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওর এক খুব ভাল বন্ধু শেফালিও গিয়েছিলেন মাঠে। তাঁর তো বুকে ইটের আঘাতে প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আর আরতির মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি শেষমেশ পুলিশ কমিশনারকে মোহনবাগান ড্রেসিংরুম থেকেই ফোন করে স্পেশ্যাল পুলিশ জিপ আনিয়ে আরতিদের বাড়ি পাঠালাম। কিন্তু আরতি প্রতিবাদসূচক একটি শব্দ মোহনবাগানকে বলেনি বা লেখেনি। বরং আমাকে বলেছে, আমি তো নিজের থেকে মাঠে গিয়েছিলাম। মোহনবাগান তো আমাকে যেতে বলেনি!

ও বলেছিল, সমর্থকেরা এ রকমই। জিতলে কাঁধে তুলে নাচবে। হারলে পায়ের তলায় পিষবে। ওতে কোচ বা কোচের পরিবারের উত্তেজিত হলে চলে না। তবে দেখতে হবে, কারও প্রাণহানির মতো গুরুতর কিছু না ঘটে যেন।

সেই সময় আবার আমার বড় মেয়ে পলার ডিপথেরিয়া ধরা পড়েছে। সাত বছরের বাচ্চা একটা মেয়ের গলা এত সাংঘাতিক ফুলে গিয়েছিল যে, যন্ত্রণায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ, কথা বন্ধ। বেলেঘাটার হাসপাতালে ভর্তি। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের দিনও আমাকে হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে। কারণ, সে দিনই দুপুরে পলাকে ডাক্তার সেরাম দেবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ, অত কমবয়সি রোগীকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় তার গার্জেনকে থাকতেই হবে সামনে।

তাতেই আমার মাঠে ঢুকতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচে তার পরেই হাবিবের সেই সিটার মিস। যার কাউন্টার অ্যাটাক থেকেই ইস্টবেঙ্গলের প্রথম গোল। ব্যস, আর যায় কোথায়! মোহনবাগান সমর্থক গ্যালারি তো বটেই, কয়েক জন মাঝারি মাপের ক্লাবকর্তাও আমাকে বলতে শুরু করে দিলেন, আপনি দেরি করে আসাতেই হাবিবের সিটার মিস। ওদের কাউন্টার অ্যাটাকে আমাদের ডিফেন্সের নড়বড়ে থাকা। ছেলেদের নাকি মনঃসংযোগে সমস্যা হচ্ছিল ততক্ষণ। এক বারও কেউ জানতে চাইলেন না, দুরারোগ্য রোগে ভোগা আমার বাচ্চা মেয়েটার অবস্থা কেমন? বাঁচবে তো?

তাতেও আমি ওই অপ্রত্যাশিত হারের পর দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নিজের দু’ঠোঁট বন্ধ রেখে প্র্যাকটিস করিয়ে গিয়েছি। মনে মনে ভেবেছি, যে দিন ধূর্জটির মতো জাগবে আমার টিম, সব তছনছ করে দেবে।

আর সত্যিই তা-ই হয়েছিল সাতাত্তরে। শিবের মতোই ভারতীয় ফুটবলে মহাপ্রলয় ঘটিয়ে মোহনবাগান দেশের প্রথম একক ক্লাব হিসেবে একই মরসুমে শিল্ড-রোভার্স-ডুরান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়ে ত্রিমুকুট জেতার নজির গড়েছিল।

পঁচাত্তরে আবার আরেক কাণ্ড! সে বার আমার ইস্টবেঙ্গলের সামনে টানা পাঁচ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ময়দানের একটা বিরল রেকর্ডকে স্পর্শ করার সোনার সুযোগ। তার মধ্যেই একটা বিশেষ ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে আমার মেয়ে পলা স্কুল থেকে কিডন্যাপ্‌ড হয়ে গেল!

একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়েকে কী ভাবে নাকি বেহুঁস করে দিয়েছিল অপহরণকারীরা। তখনকার দিনে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইলটোবাইল বলে কিস্যু নেই। তাও লালবাজার প্রায় অসাধ্যসাধন করে শেষমেশ হাওড়া স্টেশনের একটা ফাঁকা লোকাল ট্রেনের কামরা থেকে পলাকে উদ্ধার করেছিল।

আরতি তখন অন্তঃস্বত্ত্বা। সে বছরই ছোট মেয়ে পিক্সির জন্ম। ওই অবস্থায় স্কুলে মেয়ের কোনও খোঁজ না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আরতি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। জ্ঞান ফিরতে ওই শারীরিক অবস্থাতেও গোটা শহর ছুটে বেড়িয়েছে আমার স্ত্রী। কারণ পরের দিন আমার টিমের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আমি সব জায়গায় আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজতে যেতে পারছি না। যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না পেশাদারি তাড়নায়! অনেকেই সে দিন আমাকে বলেছিল, চাপ দিয়ে তিন পয়েন্ট ছাড়তে বাধ্য করতেই নাকি খেলার আগের দিন আমার পরিবারে ও রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটানো হয়েছিল! যাতে আমি বাধ্য হই আপস করতে।

কিন্তু আমি বরাবরের ঈশ্বরভক্ত মানুষ। সে জন্যই বোধহয় পরমশক্তিমান ঈশ্বর আর ফুটবলদেবতা দু’জনেরই আশীর্বাদ সে দিন আমার ওপর শেষমেশ ঝরে পড়েছিল। পলাকেও উদ্ধার করে দিয়েছিল পুলিশ। আর ম্যাচটাও সহজে জিতেছিলাম।

ফুটবলারদের কম গালমন্দ আমাকে সামলাতে হয়েছে?

বাহাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব আমি নেওয়ায় টিমেরই এক নামী সিনিয়র ফুটবলার নাকি বেজায় চটেছিল। তার পর গোটা মরসুম আমার নামে তার নানা কুত্‌সা রটানো, প্র্যাকটিসে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা, কোনও কোনও ম্যাচে নিজের পুরো একশো ভাগ না দেওয়া লক্ষ করে আমার মনে হয়েছিল, ওই সিনিয়র ডিফেন্ডার সম্পর্কে আমার কানে আসা কথাগুলো বোধহয় ঠিক।

এ রকম বেয়াড়া ফুটবলারকেও সামলানোর রাস্তা আমার জানা ছিল। বিশেষ করে, ম্যাচে ও রকম দেখলে কী করতাম, ওর পজিশনের অন্য ফুটবলারকে বেঞ্চ থেকে তুলে মাঠের ধারে ওয়ার্ম-আপ করাতাম। ওই বেয়াড়া ফুটবলার মাঠের যে সাইডে খেলছে ঠিক তার সামনের সাইডলাইনে চলত বিকল্প ফুটবলারের ওয়ার্ম-আপ নাটক! আর সেটা দেখলেই সেই সিনিয়র ফুটবলারের চালাকি বন্ধ হয়ে যেত। নিজের পুরো একশোভাগ দিয়ে তখন খেলত সে! যাতে তাকে আমি বসাতে না পারি। তবে এক তারকা ফরোয়ার্ডের অবিশ্বাস্য অভিমান নিয়ে আমি সত্যিই সমস্যায় পড়েছিলাম। কী জবাব দেব আমার সেই প্রিয় ফুটবলারের অভাবিত অভিযোগের!

সেই ফরোয়ার্ড এক দিন সস্ত্রীক আমার কাছে এসে অভিযোগ করে বসল, প্রদীপদা আমার বাড়ির লেটার বক্সে প্রায় রোজ কোনও নামধাম ছাড়া একটা-দুটো চিঠি আসছে যে, আমার বৌয়ের সঙ্গে আপনার নাকি অ্যাফেয়ার আছে! আমি কী করব প্রদীপদা!

প্রথমে কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব থেকে, তার পর সেই ফরোয়ার্ডকে বলেছিলাম, কথাটা তো ঠিকই। কারণ, তোমার বৌ আমার কন্যাসম। আর অ্যাফেয়ার মানে তো সম্পর্ক। তা বাপ-মেয়েও তো একটা সম্পর্ক, না কি? শুনে সেই ফুটবলার আর তার বৌ দু’জনেই হো হো করে হাসতে লাগল। আমিও একটা বিচ্ছিরি অবস্থা থেকে রেহাই পেয়েছিলাম যেন সে দিন।

আসলে সেই ফরোয়ার্ড তখন ইস্টবেঙ্গলে আমার কোচিংয়ে নতুন ফুটবলজীবন ফিরে পেয়েছে। ওর বিয়েও বলতে গেলে আমিই দাঁড়িয়ে দিয়েছি। ফলে এখনও মাঝেমধ্যে মনে হয়, হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের ওটা একটা নোংরা গেমপ্ল্যান ছিল মাঠে পারছি না তো, দেখি যদি অন্য ভাবে কোচ পিকে-কে মারা যায়!

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

pk bandopadhay patrika
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy