জগ্গা জাসুস
পরিচালনা: অনুরাগ বসু
অভিনয়: রণবীর কপূর, ক্যাটরিনা কাইফ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত
৭/১০
শোনা গিয়েছিল, ২০১৪ সালে ২০ দিন ‘জগ্গা জাসুস’-এর শ্যুটিং হওয়ার পর রণবীরের কাজ মনপসন্দ না হওয়ায় রি-শ্যুট করেন পরিচালক। দার্জিলিং, তাইল্যান্ড, মরোক্কোয় এই ছবির শ্যুটিং হয়েছে। এরই মাঝে ভেঙেছে রণবীর-ক্যাটরিনার রিয়েল লাইফ প্রেম। গত বছর নভেম্বরে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। প্রায় তিন বছর ধরে হাজারটা গোলমালের বেড়া টপকে অবশেষে রিলিজ হল অনুরাগ বসুর মিউজিক্যাল ছবি ‘জগ্গা জাসুস’। ডিজনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রযোজনায় ডেবিউ করলেন রণবীর কপূর।
একে থ্রিলার, তার উপরে মিউজিক্যাল—এই পাঞ্চটা ভারতীয় দর্শকের কাছে নতুন। সুতরাং দর্শকদের মনে কৌতূহল পাহাড়প্রমাণ। ছবি শুরু হচ্ছে পুরুলিয়ার পটভূমিতে। সময় ১৯৯৫। মাঠের মধ্য দিয়ে মুখোশ পরে ঝুমুর গাইতে-গাইতে যাচ্ছে কিছু নারী-পুরুষ, সেই দৃশ্য রেকর্ড করছেন কয়েক জন। আর ঠিক তখনই একটা প্লেন মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। নেমে এল অনেকগুলো প্যারাসুট, বড় বড় বাক্স নিয়ে। বাক্স থেকে বেরিয়ে এল ঝাঁ-চকচকে এ কে ৪৭! চমকে গেল সারা বিশ্ব! ১৯৯৫ সালের পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণের সত্য ঘটনাটি দিয়ে শুরু হল সিনেমার কাল্পনিক গল্প। জাম্প কাট। শ্রুতি সেনগুপ্ত ওরফে ক্যাটরিনা জগ্গা জাসুসের উপর লেখা বইয়ের গল্প শোনাচ্ছে বাচ্চাদের। এই গল্প বলার ছলেই পুরো সিনেমা।
আরও পড়ুন: ২১জুলাই মুক্তি পাচ্ছে শঙ্কুদেবের ‘কমরেড’
ময়নাগুড়ির এক হাসপাতালে জগ্গার জন্ম। জন্মের পর থেকেই মা-বাবা লা-পতা। ডাক্তার ও নার্সদের ভালবাসায় খুদে জগ্গা বড় হতে থাকে। একদিন সে দেখতে পায়, একটি লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাঠে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে জগ্গা। প্রাণে বেঁচে যায় লোকটি। এ দিকে জগ্গা কোনও কথাই বলে না। কারণ জগ্গা বেজায় তোতলা, তাই লজ্জায় কারও সঙ্গে কথা বলে না। লোকটিই শেখায়, কী ভাবে সুর করে গান গেয়ে কথা বললে, কথা আটকায় না। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে লোকটি তার নাম জানায়, ‘টুটিফুটি’ (শাশ্বত)। টুটিফুটি ও জগ্গার মধ্যে ভালবাসা বাবা-ছেলের বন্ধনের জন্ম দেয়। হাসপাতাল ছেড়ে তারা চলে গেল মণিপুর। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছোট্ট জগ্গাকে হোস্টেলে ভর্তি করে টুটিফুটি কোথায় যেন চলে গেল! টুটিফুটি ফিরে না এলেও জগ্গা প্রতি জন্মদিনে ডাক মারফত একটা ভিডিয়ো ক্যাসেট পেত। ভিডিয়োতেই টুটিফুটি তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাত, কত কিছু শেখাত। সে দাড়ি কামানো হোক বা বন্দুকে ম্যাগাজিন লোড করা। খামের উপর ডাক টিকিট দেখেই জগ্গা বুঝতে পারত, কোন দেশ থেকে টুটিফুটি পাঠিয়েছে। প্রতি বছর নতুন দেশ। ওই ক্যাসেট শিক্ষার দৌলতে জগ্গা হোস্টেলের অন্য ছেলেদের চেয়ে চিন্তায়, বুদ্ধি ও টেকনোলজির প্রয়োগে একদম আলাদা। কিন্তু একবার জন্মদিনে আর ক্যাসেট এল না! কেন? প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এই কেন-র পিছনের রহস্যের জাল বোনা হয়েছে এবং খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে জগ্গার মোলাকাত হয় সাংবাদিক শ্রুতির সঙ্গে। পাকেচক্রে শ্রুতিও জগ্গার সঙ্গে তার অভিযানে আটকে যায়।
ছবিটির কালার ট্রিটমেন্ট, সিনেম্যাটোগ্রাফি, অ্যানিমেশনের ব্যবহার, ল্যান্ডস্কেপ, ফ্রেমিং, কলাকুশলীর স্টাইলিং সব মিলিয়ে কমিকসের রঙিন পাতার মতো। ছবিটির ঘটনা, পরিস্থিতি সব কিছুই বোঝানো হয়েছে গান গেয়ে। সাধারণত দর্শক রূপকথার গল্প বা হলিউডি ছবি মিউজিক্যালে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু কোনও হিন্দি কমার্শিয়াল মিউজিক্যাল থ্রিলার তৈরি করা সহজ কথা নয়! একটি মৃত্যু রহস্যের সমাধান করার ঘটনা যে ভাবে গান গেয়ে দেখানো হয়েছে তা বাকরুদ্ধ করে দেয়। প্রীতমের সংগীত প্রশংসনীয়। কখনও বিহু, কখনও অাফ্রিকান সংগীতের সুর মিলে মিশে গিয়েছে। রণবীর আবার প্রমাণ করেছেন অভিনয়ের সুযোগ পেলে ছক্কা মারতে জানেন। ক্যাটরিনা যেমন প্রমাণ দিয়েছেন পরদায় তাঁকে অসাধারণ সুন্দরী লাগলেও অভিনয়টা শেখা বাকি। শাশ্বত, রজতাভ মন ভরিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে শাশ্বত। রণবীরের চুলের কায়দা, বই পড়ে প্লেন চালানো, উটপাখির পিঠে চড়ে পালানো, শত্রুকে জব্দ করার কায়দা ইত্যাদি মনে করিয়ে দেয় টিনটিনের অভিযানগুলোর কথা। জাদুকর বরফির কায়দায় ক্যাটরিনার নাচ, ‘শুন্ডি’, ‘আগাপাশতলা’ ইত্যাদি শব্দ মনে করিয়ে দেয় সত্যজিৎ রায়কে। প্রথম দৃশ্যে ঝুমুর গান মনে করায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘উত্তরা’ ছবিটি। আফ্রিকার ফাঁকা ধু-ধু অঞ্চলে জিরাফ, জেব্রা বা মিরক্যাটের উপস্থিতি ও ফ্রেমিং চেনা লাগবে ‘লায়ন কিং’-এর সঙ্গে।
একটি ছেলের বাবাকে খুঁজে বেড়ানোর গল্পের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বিশ্বজোড়া বেআইনি অস্ত্র পাচার ও টেররিজম সমস্যার কথাও। সিরিয়াস মুহূর্তগুলো মোড়া হয়েছে কমেডির মোড়কে। কিছু জায়গায় অবশ্য মিশেলটা আধকাঁচা। কমানো যেত ছবির দৈর্ঘ্যও। মাঝেমধ্যে জগ্গা ও শ্রুতির অভিযান প্রায় দস্যু মোহনের ভূমিকা নিয়েছে। ‘কী হইতে কী হইয়া গেল কিছুই বোঝা গেল না’ গোছের দৃশ্যের সংখ্যা বেড়েছে ছবির শেষ দিকে! এই সব ত্রুটি এড়িয়ে গেলে রং, সুর অভিনয় নিয়ে ‘জগ্গা জাসুস’ একটা জমজমাট কার্নিভাল। ছবি শেষ হল বাবা-ছেলের মিলন দিয়ে। কিন্তু সত্যিই কি মিল হল? একটা ধাঁধাঁ যেন ছেড়ে গেলেন পরিচালক। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে সিক্যুয়েলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy